সব ভাষাই আল্লাহ্র দান, আল্লাহ্র সৃষ্টি। আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টির সাথে সাথে মানুষ জাতিকে ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রথম মানুষ হজরত আদম আঃ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ ইরশাদ করেনঃ আর তিনি (আল্লাহ্) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন। (সূরা বাকারাঃ ৩১ আয়াত) জগতে কোন বস্তুর কী নাম, কার কী কাজ, কার সাথে কার কেমন সম্পর্ক¬ প্রভৃতি সব বিষয়ের ভাষাজ্ঞান আল্লাহ্ আদম আঃ-কে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ্ অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ আর রহমান-দয়াময় আল্লাহ্। তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা। (সূরা আর রহমানঃ ১-৪ আয়াত)।
মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা¬ মানুষের অস্তিত্বের এ তিনটি প্রধান অবলম্বন। মানুষের জীবন হচ্ছে তার মাতৃভাষা, দেশের ভাষা, জাতির ভাষা। মানুষের যতগুলো জন্মগত অধিকার আছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে মাতৃভাষার অধিকার। এ অধিকার আল্লাহই মানুষকে দিয়েছেন। তবুও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যুগে যুগে এই জন্মগত অধিকার হরণ করার হীন প্রচেষ্টা চলেছে আমাদের এই স্বাধীনচেতা বীর বাঙালিদের ভূখণ্ডে।মুখের ভাষা পৃথিবীতে একমাত্র মানুষকেই দেয়া হয়েছে। মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ভূষিত হওয়ার যে সকল যোগ্যতা ও গুণাবলী রয়েছে ভাষাও তার মধ্যে একটি। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যদিও ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক দিয়ে ছিল ভিন্নতা। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বীয় মাতৃভাষাকে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চালায়। তাদের এ চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছাত্রগোষ্ঠী মাতৃভাষার টানে রাজপথে নেমে এসেছিল। পুলিশের বুলেটের সামনেও তাদের মাতৃভাষাকে পদানত করতে দেয়নি। মাতৃভাষার এ অকৃত্রিম ভালোবাসাকে স্মৃতিময় করতে ২০০০ ইং সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে বাংলাভাষাকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। মাতৃভাষার প্রতি এ অম্লান ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি ইসলাম দিয়েছে।
মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ ও ইসলাম
১। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে আসমানী কিতাবসহ অগণিত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন মানুষকে সৎপথে পথ প্রদর্শন করার জন্য। তাদের নিকট যে ঐশ্বী বাণী দেয়া হয়েছিল তা ছিল স্বীয় মাতৃভাষায়। এ কারণেই প্রধান ৪ খানা আসমানী গ্রন্থ আরবী, ছুরিয়ানী, হিব্রু ও ইবরানী ভাষায় নাযিল করা হয়। পরোক্ষভাবে এ দ্বারা মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
২। বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাতৃভাষা আরবী, সে সময় আরব ভাষাভাষী বিশ্বের বুকে ছিল অপ্রতুল, তথাপিও মাতৃভাষায় আরবীতে আল্লাহ কুরআন নাযিল করেন। সাথে সাথে ইসলামী বিধি বিধান পালনের ক্ষেত্রেও মাতৃভাষা আরবীকে নির্ধারণ করা হয়। মাতৃভাষার প্রতি ইসলামের সমর্থনে এ এক উৎকৃষ্ট উপমা।
৩। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘‘আমি কুরআনকে আরবী ভাষায় নাযিল করেছি এজন্য যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পারো। (সূরা ইউসুফ-২) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘আমি সকল নবীকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি যাতে তাদের নিকট সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। (সূরা ইব্রাহিম-১৪) আল্লাহর এ সকল বাণী মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
৪। আল্লাহতা’আলা মানুষকে লক্ষ করে ইরশাদ করেছেনঃ আর তাঁর নিদর্শনাবলির অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন। (সূরা রুমঃ ২১ আয়াত) এ আয়াতে দেখা যায়, মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা আল্লাহর সুনিপুণ সৃষ্টিকৌশলের অন্যতম সুশীলিত বহিঃপ্রকাশ। এ জন্য ভাষা-বর্ণ প্রভৃতির কারণে কোনো বিশেষ অঞ্চলের মানুষদের পর্যুদস্ত করার চেষ্টা ইসলামসম্মত নয়। ইসলামের নামে অন্যের ভাষা কেড়ে নেয়ার সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলাম সব বর্ণের মানুষের ধর্ম। ইসলাম সব ভাষাভাষী মানুষের ধর্ম।
৫। হজরত মুহাম্মদ সাঃ পর্যন্ত প্রত্যেক জাতির জন্য অন্তত একজন করে নবী নির্দিষ্ট ছিল। (দেখুন সূরা ইউনুসঃ ৪৭ আয়াত) আর এই জন্যই প্রত্যেক রাসূলের ভাষা ছিল তাঁর জাতির তাঁর অঞ্চলের মাতৃভাষা। আল্লাহ্তা’আলা ইরশাদ করেনঃ আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জন্য। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন আর যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়, (সূরা ইবরাহিমঃ ৪ আয়াত)
৬। আল্লাহ পাক নবীজীর মাতৃভাষাতে কুরআন নাজিল করে তা সহজ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অতঃপর আমরা এ কুরআনকে তোমার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি। যাতে মুত্তাকিদেরকে এর (বেহেশতের) সুসংবাদ দিতে পার আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে (দোজখের) ভয় দেখাতে পারো। (সূরা মারইয়ামঃ আয়াত-৯৭) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, এটা রুহুল আমিন-জিব্রাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারো। (সূরা শুয়ারাঃ আয়াত ১১৩-১১৫)।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কেবল আমাদের চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। শহীদ মিনার ধোয়ামোছা, শহীদ মিনারে প্রভাতফেরির অনুষ্ঠান, গান গাওয়া, সরকারি-বেসরকারি নানা মাত্রিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই আমরা একুশকে স্মরণ করি। একুশ আসে, একুশ যায়। একুশের চেতনা কি বছরের বাকি ১১ মাস আমাদের মাঝে জাগ্রত থাকে¬ এ প্রশ্ন অনেকের মনেই উদয় হয়। সর্বস্তরে মাতৃভাষার চর্চা এখনো কাগুজেই রয়ে গেছে, দেশের সব শিশুকে আমরা মাতৃভাষা শিক্ষা দিতে পারিনি।
বাংলা ভাষা বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক ভাষা না হলেও ভাষার জন্য রক্ত ঝরানোর মত দুর্লভ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য দেশ যদি তাদের ভাষায় সকল কিছু সফলতার সাথে সম্পাদন করতে পারে আমরা কেন পারবো না। আমরা মুসলমান হয়েও বিধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার দ্বারা কেন প্রভাবিত হব? পরিশেষে সর্বস্তরের পেশাজীবির নিকট আহবান জানাচ্ছি আসুন সমৃদ্ধশালী একটি দেশ গড়তে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার দ্বারা ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতন হই।
তথ্যসূত্রঃ
অধ্যক্ষ তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা
অধ্যাপক মাওলানা আহমদ আবুল কালাম
অধ্যাপক মাওলানা মোঃ শফিকুর রহমান
অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন
ও নেট