Archive for October, 2020

মৃত্যু

কিছুদিন আগে পত্রিকার দুটো রিপোর্ট পড়ে মৃত্যু নিয়ে ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন লিখা মার্জ করেই আজকের এই লিখা। অনেক বড়। কিন্তু পার্ট বাই পার্ট দিচ্ছি না। উপন্যাস হলে দিতাম। সেখানে অনেক চরিত্র থাকে। এই লিখায় চরিত্র একটিই- যার নাম “মৃত্যু”

Description: Description: 🎗️১৩ ঘণ্টার ব্যবধানে মা, বাবা ও বোনকে হারালেন তিনি।

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২২:০৩  প্রথম আলো

সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন মিরাজুল ইসলামকে (৪৫)। কেননা সারা দিনটা কেটেছে তাঁর কবরস্থানে প্রিয়জনের লাশ নামাতে। রাতে অসুস্থ হয়ে মারা যান তাঁর মা। মাকে সকালে দাফন করার পরপরই শুনতে পান বোন মারা গেছেন। বোনের মৃত্যুর এক ঘণ্টা পরই মৃত্যু হয় বাবার।

Description: Description: 🎗️শিশু বুলবুলির (৮) নিথর দেহখানি পুকুরের পানি থেকে তুলে আনার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বাবা শাহজাহান ও চাচা শারফুল। একপর্যায়ে মৃত ভাতিজিকে বুকে নিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে আর্তনাদ করতে থাকেন চাচা শারফুল। ১৮ আগস্ট ২০২০ সব পত্রিকায় চাচা ভাতিজির সেই ছবিটি দেখলে অজান্তেই আপনার চোখ ভিজে যাবে।

কত আপনজনকে হারিয়েছি। চোখের সামনে কত মৃত্যু দেখিছি। তাও বুঝি নি মৃত্যুর মতো সত্য আর কিছু নেই। সব আত্মাকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে স্থায়ী নয় কেউ-ই। মৃত্যু হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনে গমন।মানুষকে ঐ জীবনের প্রস্তুতি নিতে হয় এই জীবনের সমাপ্তির আগেই। মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে করে সৎকর্মমুখী ও কর্মতৎপর। জীবন তো ফুরিয়ে যায়  পলে পলে যেমন এক বরফ খন্ড নিঃশেষ হয় ফোঁটায় ফোঁটায়। তাই একটি ভালো কাজ-তা যত ছোটই হোক,  হতে পারে আখিরাতের সঞ্চয়, একটি আলোকিত বাক্য, হতে পারে কারো হেদায়েতের উপায়, কারো একটু উপকার হয়ে যেতে পারে নাজাতের উসীলা।শুধু মানুষই জানে যে তাকে একদিন মরতে হবে। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে মানবজাতিকে তার মৃত্যুর কথা অবহিত করেছেন। নবী-রাসুলরা তাঁদের উম্মতদের পার্থিব জীবনের পর আরেকটি জীবনের কথা বর্ণনা করেছেন যাতে তারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। মৃত্যু যদি জীবনাবসানের নাম হতো, তবে পৃথিবীতে যার যার ইচ্ছামতো চলার সুযোগ থাকত। কিন্তু মুমিন মাত্রই বিশ্বাস করে যে মৃত্যু মানে এক জীবন থেকে আরেক জীবনে প্রত্যাবর্তন। দুনিয়ার টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবান্ধব সবাইকে ছেড়ে একদিন পাড়ি জমাতে হবে ওপাড়ে।নিজেকেই নিজের দায়িত্ব নিতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘শেষ বিচারের দিন মানুষ তার ভাই থেকে পলায়ন করবে এবং তার মাতা-পিতা থেকে তার স্ত্রী ও তার সন্তান থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যকের অবস্থা এত গুরুতর হবে যে, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে।’ [৮০] আবাসা : ৩৪-৩৭

সেদিন কেউ কারো উপকার করতে পারবে না। কেউ কারো কোন কাজেও আসবে না। সেদিনের ভয়াবহতায় মানুষ বলবে-

“হায়! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম।” (সূরাহ নাবা, আয়াত : ৪০)

“হায়! যদি পরকালের জন্য কিছু করতাম।” (সূরাহ ফজর, আয়াত : ২৪)

“হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা না দেওয়া হতো।” (সূরাহ আল-হাক্কা, আয়াত : ২৫)

“হায়! আমি যদি ওকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।” (সূরাহ ফুরকান, আয়াত : ২৮)

“হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল ﷺ এর আনুগত্য করতাম।” (সূরা আহযাব, আয়াত : ৬৬)

“হায়! আমি যদি রাসূল ﷺ এর পথ অবলম্বন করতাম।” (সূরাহ ফুরকান, আয়াত : ২৭)

“হায়! আমি যদি আমার রবের সঙ্গে কাউকে শরীক না করতাম।” (সূরা কাহফ, আয়াত : ৪২)

“হায়! আমাদেরকে যদি আবার দুনিয়াতে পাঠানো হতো (সূরাহ আনআম, আয়াত : ২৭)

আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার মৃত্যুর কথা জানিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু কখন, কার কোন জায়গায় মৃত্যু হবে, তা গোপন করেছেন। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মৃত্যুবরণ করতে পারে না। সে জন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে (সুরা আলে ইমরান: ১৪৫)। মৃত্যুর সময় অজ্ঞাত হওয়ার কারণে মানুষ মনে করে সে দীর্ঘজীবী হবে, এমনকি মৃত্যুর কথাও ভুলে যায়।

অথচ আল্লাহ বলেছেন

প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে- সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৫; সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫; সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৫; সুরা আনকাবুত, আয়াত ৫৭

আল্লাহ্ই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদেরকে রিযক দিয়েছেন, অতঃপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর তোমাদেরকে জীবিত করবেন।[৩০] আর-রূম : ৪০।

তিনিই সেই সত্তা, যিনি মানুষকে হাসান এবং কাঁদান। তিনিই তো মৃত্যু দেন, জীবন দেন। ’ (সুরা নাজম, আয়াত: ৪৩)

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রাসুল! সবচাইতে বুদ্ধিমান লোক কে? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি অধিকহারে মৃত্যুকে স্মরণ করে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত থাকে।’ (ইবনে মাজাহ)

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- হে মানব সম্প্রদায়! সুখ-শান্তি বিনাশকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি করে স্মরণ করো। (তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)

মৃত্যুর স্মরণে ক্ষতি নেই; বরং আছে উপকার, বহু উপকার। মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে দান করে ক্ষণস্থায়িত্বের উপলব্ধি। এ উপলব্ধি মানুষের মোহমুক্তি ঘটায়। অর্থ-বিত্ত, পদ-পদবী, ভোগ-ফূর্তি এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মোহই তো সকল ব্যাধির মূল, ব্যক্তি ও সমাজের সকল অশান্তির কারণ। মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে মুক্ত করে এই মোহগ্রস্ততা থেকে । তাই তা এক মহৌষধ মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক শুদ্ধির।

 মৃত্যু থেকে কেউ পালাতে পারবে না।

বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে [সুরা আল জুমুআহ: আয়াত ৮]‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও।’ [সুরা আন নিসা: আয়াত- ৭৮]

মানুষ স্বীয় জীবন যেভাবে চালিত করে আল্লাহ ঐভাবেই তার মৃত্যু দিয়ে থাকেন। যার উপরে তার মৃত্যু সংঘটিত হবে তার উপরই কিয়ামতে দিন তাকে উত্থিত করবেন।মৃত্যু কোনো বান্দাকে সময় দেয় না। গোছগাছ করার জন্য কোনো ধরনের সুযোগও দেয় না।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তোমাদের যে জীবিকা দিয়েছি, তা থেকে দান করো তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই। তখন সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে অল্প সময়ের জন্য অবকাশ দিলে না কেন, তাহলে আমি সাদকা করতাম এবং আমি নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। যখন কারো নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেন না। তোমরা কী আমল করো আল্লাহ তার খবর রাখেন।’ (সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ১০, ১১)

মৃত ব্যক্তিকে অনুসরণ করে তিন বস্তু। তারপর দুটি ফিরে আসে, একটি তার সঙ্গে থাকে। তাকে অনুসরণ করে পরিবারের লোকজন, (কিছু) সম্পদ ও তার আমল। পরে পরিবারের লোকজন ও সম্পদ ফিরে আসে, সঙ্গে থাকে শুধু আমল। (মুসলিম, হাদিস : ৭৬১৩)তাই আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। [৩] আল ইমরান : ১০২

ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর জীবনের অন্তিমকালে হযরত উসমান (রাঃ) কে ডেকে ওসিয়ত ও উপদেশ লিপিবদ্ধ করেন। সেই ঐতিহাসিক দলিলটি এইঃ-

“পরম দয়ালু ও মেহেরবান আল্লাহর নামে, আল্লাহর দাস এবং মুসলমানদের নেতা আবু কুহাফার পুত্র আবু বকর তাঁর ইন্তিকালের মুহূর্তে তাঁর পরবর্তী খলীফা ও মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এই ওসিয়তনামা লিপিবদ্ধ করেছেন এবং স্মরণ করাচ্ছেন যে, মৃত্যুকাল এমনই এক কঠিন সময় যে সময়ের কষ্ট ও ভয়াবহতায় অভিভূত হয়ে কাফিরও মুমিন হতে চায়, চরিত্রহীন ব্যক্তি চরিত্রবান হতে চায় এবং মিথ্যাচারী সত্যের আশ্রয় গ্রহণের জন্যে হয়ে ওঠে ব্যাকুল।

“মুসলমানগণ! আমি আমার পরে খাত্তাবের পুত্র উমারকে তোমাদের জন্য খলীফা নিযুক্ত করছি। আমার বিশ্বাস, উমার নিরপেক্ষভাবে শাসকনদন্ড পরিচালনা করে ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করবেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রমের দায়িত্ব তাঁর নিজের, কারণ আমি তাঁর বর্তমান ও অতীত জীবনের পরিচয়ের উপর নির্ভর করে তাঁকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি, কিন্তু ভবিষ্যতের দায়িত্ব আমার নয়। কারণ আমি অন্তর্যামী নই।

এরপর তিনি উপদেশ দেন “হে ওমর, মৃত্যু প্রত্যেক জীবের জন্য এবং তোমার জন্যও অবধারিত রয়েছে, তাকেই সর্বাপেক্ষা প্রিয়জ্ঞানে সব সময় স্মরণে রাখবে। মনে রেখো, খোদাপ্রেমিক পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যে ব্যাকুলিত ভাবে জীবন যাপন করেন, আর অকর্মশীল ব্যক্তিরাই সর্বদা মৃত্যুভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। কিন্তু অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে কারুরই রেহাই নেই।”

আবদুল আযীয ইবনে মারওয়ান রঃ এর যখন মৃত্যু সময় ঘনিয়ে আসল তখন তিনি বললেন যে কাপরে আমাকে কাফন পড়ানো হবে তা আমার কাছে নিয়ে সো তো, আমি একটু দেখে নেই।কাপরটি তার সামনে রাখা হলে ওটার দিকে তাকিয়ে বললেন দুনিয়ার তো আমার অংশ এটাই ছিল। এটুকু দুনিয়া নিয়ে আমি যাচ্ছি। অতঃপর তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন হে দুনিয়া তোমার অধিকও অল্প এবং তোমার অল্পতো খুবই ছোট। আফসোস আমরা ধোকার মধ্যেই পরে আছি।

আল্লাহ তায়ালা হুদহুদ পাখিকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন যে, সে ভূগর্ভের বস্তুসমূহকে এবং ভূগর্ভে প্রবাহিত পানি উপর থেকে দেখতে পায়। হযরত সুলায়মান আঃ হুদহুদকে এজন্যেই বিশেষভাবে খোঁ’জ করেছিলেন যে, এতদঞ্চলে কোথায় মরুগর্ভে পানি লুকায়িত আছে, সেটা জেনে নিয়ে সেখানে জিন দ্বারা খনন করে যাতে দ্রুত পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়। একদা হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাঃ ‘হুদহুদ’ পাখি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তখন নাফে ইবনুল আযরক্ব তাকে বলেন, আপনি তো আজ হেরে গেলেন! হুদহুদ পাখি মাটির গভীরে দেখতে পায়। অথচ তাকে ধরার জন্য মাটির উপরে বিস্তৃত জাল সে দেখতে পায় না। যখন সে তাতে পতিত হয়। জবাবে ইবনু আববাস রাঃ বলেন, তুমি মনে করবে যে আমি নিরুত্তর হয়ে গেছি এরুপ ধারনা না করলে আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন মনে করতাম না। যখন মৃত্যু এসে যায়, চক্ষু অন্ধ হয়ে যায় বেং জ্ঞান লোপ পায়। চমৎকার এ জবাবে মুগ্ধ হয়ে  নাফে নিরুত্তর হয়ে যায় আর বলে আল্লাহর কসম আর আমি আপনার কথার কোন প্রতিবাদ করব না।

বুদ্ধিমান সে-ই যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করে। আর অক্ষম সে-ই যে নিজের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলে এবং আল্লাহর কাছে (বৃথা) আশা পোষণ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলতেন, ‘যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন সকালের জন্য অপেক্ষা কোরো না, আর যখন তোমার সকাল হয় তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা কোরো না। অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও আর তোমার মৃত্যুর জন্য জীবিতাবস্থায় পাথেয় জোগাড় করে নাও।(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪১৬)

কিছু সাদকায়ে জারিয়া আছে, যেগুলো মৃত্যুর পরও মুসলমানের সঙ্গে যোগ হতে থাকে। যেমন—হাদিসে এসেছে : মুমিনের যেসব নেক আমল মৃত্যুর পরও তার আমলনামায় যোগ হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইলম, যা কেউ শিক্ষা করে এবং প্রচার করে। নেককার সন্তান, যাকে দুনিয়ায় রেখে যায়। কোরআন শরিফ, যা উত্তরাধিকার সম্পদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে যায়। মসজিদ, যা নির্মাণ করে যায়। মুসাফিরখানা, যা তৈরি করে যায়। খাল, যা খনন করে যায়। সাদকায়ে জারিয়া, যা জীবন থাকতে সুস্থ অবস্থায় নিজের সম্পদ থেকে আলাদা করে রেখে যায়। মানুষের মৃত্যুর পরও এগুলো তার আমলনামায় যোগ হতে থাকে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪২)

যত বয়সেই উপনীত হোক না কেনো, মানুষ মরতে চায় না।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, বৃদ্ধ লোকের অন্তর দুটি ব্যাপারে সর্বদা যুবক থাকে। এর একটি হল দুনিয়ার মহব্বত, আরেকটি হল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সহীহ বোখারী- ৫৯৭৮। তবুও  মৃত্যুর সময় আমাদের আশা পোষন করতে হবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন আল্লাহ সম্পর্কে সু ধারণা না নিয়ে মারা না যায়” [মুসলিম; ২৮৭৭]।

ঘটনা একঃ মুহাম্মাদ (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বেদুঈনের কাছে প্রবেশ করলেন তার রোগের খোজ খবর নিতে। তিনি বললেনঃ তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই ইনশা আল্লাহ তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। বেদুঈন বলল সুস্থতা? না, বরং এটি এমন জ্বর যা একজন প্রবীণ বুড়োকে সিদ্ধ করছে, ফলে তাকে কবরে নিয়ে ছাড়বে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, তাহলে সেরূপই। সহীহ বোখারী -৬৯৬২।

ঘটনা দুইঃ একটি লোকের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন নিজেকে তুমি কি অবস্থ্য পাচ্ছ? লোকটি বলল আমি আল্লাহকে ভয় করছি ও তাঁর রহমতে আশা করছি। রাসুলুল্লাহ সাঃ তখন তাকে বললেন “ এরুপ সময়ে যার অন্তরে এদুটি জিনিস একত্রিত হয় তার আশা আল্লাহ পুরন করে থাকেন এবং যা হতে সে ভয় করে তা হতে মুক্তি দান করেন- তিরমিযী -ইবনে মাজাহ।

একদিন আমাদের বাবা-মাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসতে হবে, এই নিয়তি মেনে নেওয়াটা বড় কষ্টের। কিন্তু নিজের সন্তানকে কোনোদিন নিজের হাতে কাফনে জড়িয়ে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসবো, এই চিন্তা কোনো বাবা-মা’র পক্ষে করা সম্ভব নয়। আদরের ছোট শিশু সন্তানকে কবর দেওয়ার মত কষ্টের অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। রাসুল عليه السلام এর সাতটি সন্তান ছিল। ছয়টি সন্তানই অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল, শুধুই ফাতিমা (রা) বেঁচে ছিলেন। রাসুল عليه السلام নিজের হাতে ছয়-ছয়টি সন্তানকে কবর দিয়েছেন।

আমরা কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবো না সেটা কত কষ্টের অভিজ্ঞতা হতে পারে। বিশেষ করে তার শিশু সন্তান আব্দাল্লাহ এর মৃত্যুর অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি কষ্টের।

মৃত্যু মানে আল্লাহর تعالى সম্পত্তি আল্লাহর تعالى কাছে ফিরে যাওয়া —এর বেশি কিছু নয়। এর থেকে বেশি কিছু বানালেই অশান্তি, হতাশা, বেদনা, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি নানা জটিলতা হয়। বিধর্মীদের মৃত্যু নিয়ে বিকৃত সব ধারণা, নাস্তিকদের জীবনকে আঁকড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা এবং জীবনটাকে খুব বেশি বড় করে দেখা — এগুলোর প্রভাব মুসলিমদের উপর পড়ে আজকে এই সব জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

‘যখন বান্দার সান্তান মারা যায় আল্লাহ তায়ালা তাঁর ফেরেশতাদের বলেন-তোমরা আমার বান্দার সন্তানকে কবজ করেছ?তারা বলেন- জী হাঁ!আল্লাহ তায়ালা বলেন- তোমরা তার কলিজার টুকরা’কে কবজ করেছ?তারা বলেন-জী হাঁ!আল্লাহ বলেন- আমার বান্দা কি বলেছে?তারা বলেন-সে আপনার হাম্দ করেছে ও ইন্নালিল্লাহ… বলেছে।আল্লাহ বলেন-আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ কর আর তার নাম রাখ ‘বাইতুল হাম্দ’ প্রশংসার ঘর)। (জামে তিরমিযী, হাদিস: ১০২১ (‘হাসান’ সনদে)।

সবার মৃত্যুযন্ত্রণা আলাদা। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, পিপড়ার কামড়ের কারণে যতটুকু কষ্ট বোধ হয় একজন শহিদ মৃত্যুর সময় অনেকটা সেরকম কষ্ট বোধ করবে। ইমাম আহমেদ রঃ যখন মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলেন তখন জানতে পারলেন হযরত তাউস রঃ এর মতে ফেরেশতারা এটাও লিখে রাখেন । তখন তিনি কাতরানোও বন্ধ করে দেন। আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন। তিনি মৃত্যুর সময় উহ পর্যন্ত করেননি।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন-‘কোনো মুমিন বান্দার যখন দুনিয়া থেকে আখেরাতে পাড়ি জমানোর (মৃত্যুর) সময় উপস্থিত হয়; তখন আসমান থেকে সাদা চেহারা বিশিষ্ট ফেরেশতারা নিচে নেমে আসেন। তাদের চেহারা সূর্যের মতো আলোকজ্জ্বল হয়। তাদের সঙ্গে থাকে বেহেশতের কাফন ও সুগন্ধি। তাঁরা তার (মৃতব্যক্তির) চোখের সীমানায় এবং মৃত্যুর ফেরেশতা (মৃতব্যক্তির) মাথার কাছে বসেন। তিনি (মৃত্যুর ফেরেশতা) বলেন, ‘হে পবিত্র ও নেক আত্মা! তুমি আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে আস। তখন আত্মা বেরিয়ে আসে, যেভাবে কলসি থেকে পানি বেরিয়ে আসে।তখন ফেরেশতারা (মুমিন ব্যক্তির ওই) আত্মাকে ধরবেন; তাঁকে বেহেশতের আতরযুক্ত কাফনে রাখবেন; সেই কাফন থেকে পৃথিবীর সর্বোত্তম মেশকের সুঘ্রাণ বের হতে থাকবে। তারপর তারা তা (আত্মা/রূহ) নিয়ে ওপরে যাবেন। তারা যখন কোনো ফেরেশতা দলের কাছ দিয়ে অতিক্রম করবেন, তখন ফেরেশতারা বলবে, এটি একটি উত্তম আত্মা। বহনকারী ফেরেশতারা বলবেন, ‘এটি অমুকের আত্মা। অর্থাৎ তারা দুনিয়াতে তার নামের পরিচয় দেবেন। তারা দুনিয়ার আসমান পর্যন্ত দরজা খুলে দিতে বলবেন। তখন দরজা খুলে দেয়া হবে। তারপর ঘনিষ্ঠ ফেরেশতারা পরবর্তী আসমান পর্যন্ত তাকে বিদায় জানাবেন। সপ্তম আসমান পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। অতপর আল্লাহ তাআলা আদেশ দেবেন- ‘আমার বান্দার দফতর ইল্লিয়্যিনে লিখে রাখে;’ আর ইল্লিয়্যিন হচ্ছে সপ্তম আসমানে মুমিন বান্দার আত্মা সংরক্ষণের স্থান। মুমিন বান্দার আত্মাকে পুনরায় জমিনে (কবরে) তার দেহে ফেরত পাঠানো হবে। এরপর দু’জন ফেরেশতা এসে তাঁকে (মৃতব্যক্তিকে) কবরে বসাবেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন– তোমার রব কে? আত্মা বলবে- আমার রব আল্লাহ।- তারপর জিজ্ঞাসা করবেন, তোমার দ্বীন কি? আত্মা বলবে- আমার দ্বীন ইসলাম।- ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করবেন, তোমার কাছে প্রেরিত লোকটি কে?আত্মা বলবে- তিনি আল্লাহর রাসুল।- তারপর জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কিভাবে জানো?আত্মা বলবে- আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি, এর ওপর ঈমান এনেছি এবং তা বিশ্বাস করেছি।এরপর আকাশ থেকে একজন আহ্বানকারী আওয়াজ দিয়ে বলবেন-‘আমার বান্দা ঠিক বলেছে’ তার জন্য বেহেশতের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং বেহেশতের একটি দরজা তাতে খুলে দাও। তখন সে বেহেশতের সুঘ্রাণ ও প্রশান্তি লাভ করবে। তার কবরকে নিজ চোখের দৃষ্টি সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে।রাবি (হজরত বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘তার কাছে সুন্দর চেহারা বিশিষ্ট একজন লোক আসবে’ যার পরনে সুন্দর কাপড় ও শরীরে সুঘ্রাণ থাকবে। সে বলবে, ‘তুমি সুখের সুসংবাদ গ্রহণ কর। এটি সেই দিন, যে দিন সম্পর্কে তোমাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।’আত্মা তাঁকে প্রশ্ন করবে- তুমি কে? সুন্দর চেহারা নিয়ে কে আমাকে সুসংবাদ দিচ্ছ।লোকটি উত্তর দেবে- আমি তোমার নেক আমল বা ভাল কাজ।> তারপর (মুমিন ব্যক্তির) আত্মা ফরিয়াদ করতে থাকবে-‘হে আমার রব! কেয়ামত কায়েম কর; কেয়ামত ঘটাও; যেন আমি আমার পরিবার-পরিজন ও মাল-সম্পদের কাছে যেতে পারি।’

কিন্তু পাপীদের জন্য মৃত্যুযন্ত্রণা ভয়াবহ কষ্টের।

‘দূরাচারীরা কি মনে করে যে, তাদের জীবন ও মৃত্যু এবং বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলদের জীবন ও মৃত্যু একইরকম হবে? কত ভ্রান্ত ধারণা ওদের!’ (সূরা জাসিয়া, আয়াত ২১)

সারাজীবন অন্যায় করে মৃত্যু শয্যায় এসে যারা বলে, আমি তওবা করলাম, তাদের তওবা কোন কাজে আসবে না। আর সত্য অস্বীকারকারী হিসেবেই যারা মৃত্যুবরণ করে, তাদের জন্যেও তওবা নয়। তাদের জন্যে আমি নিদারুণ শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি।’ (সূরা নিসা, আয়াত ১৮)

অর্থাৎ তুমি যদি দেখতে পেতে ফিরিশতাগণ কাফেরদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ হরণ করছে এবং বলছে, ‘তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ করো।’ -সুরা আনফাল : ৫০

রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, মালাকুল মাউতের থাবা এক হাজার তরবারির আঘাত হতেও কঠিন হবে। -শরহুস সুদুর : ২০

হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. হতে বর্ণিত আছে, করাত দিয়ে চিড়লে বা কাঁচি দিয়ে চামড়া ছিললে কিংবা কাউকে তপ্ত পানির পাতিলায় নিক্ষেপ করলেও সে পরিমাণ কষ্ট বোধ হবে না যে পরিমাণ কষ্ট মৃত্যুর সময় বোধ হবে। -ইয়াইইয়াউল উলুম ৩৯৪/৪ ৪.

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার হজরত কাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছিলেন, আমাকে মৃত্যুর অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন। তখন হজরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘মৃত্যু হলো কাঁটাদার গাছের মতো। কাঁটাযুক্ত সে গাছটি যখন মানুষের পেটে ঢোকানোর পর তার প্রতিটি কাঁটা শিরায় শিরায় লেগে যায়।তখন একজন শক্তিশালী মানুষ যদি গাছিটি ধরে জোরে টেনে বের করার চেষ্টা করে। ওই মুহূর্তে শিরায় শিরায় বিদ্ধ হওয়া কাঁটার আঘাতের কষ্ট মানুষটি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে।অনুরূপভাবে মানুষের মৃত্যুকালীন সময়ে মৃত্যুপথযাত্রীর কাছেও মনে হয় যেন, তার শরীরের গোশতগুলো যেন একটি কাঁটার সঙ্গে বেরিয়ে আসছে। সে মৃত্যুযন্ত্রণা মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে থাকে।

বনি ইসরাঈলের একটি দল একদা একটি কবরস্থানের নিকটে এসে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, আমরা দুই রাকাত নামায আদায় করে আল্লাহর কাছে মিনতি করবো, তিনি যেনো কবর হতে কোনো একজনকে উঠিয়ে আমাদের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে আমরা তার কাছ থেকে মৃত্যুর অবস্থা জেনে নিতে পারবো। যদি আমরা এ কাজটি করতে পারি তাহলে তা আমাদের জন্যে অনেক উপকারী হবে। এরপর তারা সেরকম সিদ্ধামত্ম নিয়ে দুরাকাত নামায আদায় করে আল্লাহর দরবারে আরজি জানালো। ইত্যবসরে একজন কালো বর্ণের মুরদা কবর থেকে উঠে আসলো। লোকটির কপালে সেজদার নিশান পড়া ছিলো। সে বললো, তোমরা আমার কাছে কী জানতে চাও? একশ বছর পূর্বে আমার মৃত্যু হয়েছে কিন্তু এখন পর্যমত্ম মৃত্যুর তিক্ত বিভীষিকা আমি ভুলতে পারিনি। তোমরা আমার জন্যে আল্লাহর কাছে দুআ করো, তিনি যেনো আমাকে পূর্বের মতো করে দেন।

মৃত্যু কামনা

৬৭৪১। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ মৃত্যু কামনা করবে না। কেননা, (কামনাকারী) সে যদি সৎকর্মশীল হয় তবে (বেঁচে থাকলে) হয়ত সে সৎকর্ম করবে। কিংবা সে পাপাচারী হবে, তাহলে হয়ত সে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করবে।

৫৯১১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ কোন বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা করবে না। আর যদি কেউ এমন অবস্থাতে পতিত হয় যে, তাকে মৃত্যু কামনা করতেই হয় তবে সে (মৃত্যু কামনা না করে) দু’আ করবেঃ ইয়া আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকা আমার জন্য মঙ্গলজনক হয় ততদিন আমাকে জীবিত রাখো, আর যখন আমার জন্য মৃত্যু মঙ্গলজনক হয় তখন আমার মৃত্যু দাও।

৫৯৭৭। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ, আল্লাহ তা’আলা যাকে দীর্ঘায়ু করেছেন, এমনকি যাকে ষাট বছরে পৌছিয়েছেন তার ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি।

আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ

‘যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে) প্রেরণ করুন। যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনই নয়, এ তো তার একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।’ [সুরা আল মুমিনুন : আয়াত ৯৯-১০০]

সেখানে তারা চিৎকার করে বলবে- হে আমাদের পালনকর্তা! বের করুন আমাদেরকে, আমরা সৎকাজ করব, আমরা যে কাজ করতাম তা করব না। আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি যে, তখন কেউ নসীহত গ্রহণ করতে চাইলে নসীহত গ্রহণ করতে পারতে? আর তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল। কাজেই শাস্তি ভোগ কর, যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। [৩৫] ফাতির : ৩৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বলেছেনঃ তোমরা মৃত ব্যাক্তিদেরকে গালি দিও না। কারণ তারা তাদের কৃতকর্মের পরিণাম ফল পর্যন্ত পৌছে গিয়েছে। সহীহ বোখারী- ৬০৭২।

মৃত্যুকে খারাপ মনে করার কিছু নেই। মৃত্যু মুমিনের জন্য ফিতনা হতে উত্তম। ইয়া গাফুরুর রাহিম- তুমি আমাদের বন্ধুকে ও সমস্ত মৃত মুসলমান নর-নারীকে ক্ষমা করে দাও। আমাদের ফিতনা থেকে রক্ষা করো। ইয়া আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকা আমার জন্য মঙ্গলজনক হয় ততদিন আমাকে জীবিত রাখো, আর যখন আমার জন্য মৃত্যু মঙ্গলজনক হয় তখন আমার মৃত্যু দাও।

প্রেম পবিত্র, প্রেম স্বর্গীয় -ইউসুফ নবী

প্রেম পবিত্র, প্রেম স্বর্গীয়, প্রেম আসে স্বর্গ থেকে। মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান। কারো মনে আঘাত দিলে সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে। বিটিভি
বাংলা সিনেমা আর ছায়াছন্দের প্রভাব ছিল জীবনে অপরিসীম। প্রেমের সাথে স্বর্গ বা কাবার সম্পর্ক না পেলেও প্রেম যে একটা ‘পবিত্র ব্যাপার’ সেটা মাথায় ঢুকে গেল। একটা থিউরী এস্টাব্লিসড করতে গেলে কিছু লজিকও সেট করতে হয়। প্রেম মানেই আমৃত্যু ভালোবাসা। এই ভালবাসার একমাত্র পরিনিতি বিয়ে। কিন্তু প্রেম তো  জেগে উঠছে বিয়ের বয়সের(?) অনেক আগেই। তাই এই ‘পবিত্র প্রেম’ ই পারে অন্যান্য অপবিত্র প্রেম থেকে, জাস্ট ফ্রেন্ড অর মোর দেন আ ফ্রেন্ড থেকে নিজেকে পবিত্র রাখতে।
আমার এই তথাকথিত ‘পবিত্র প্রেম’ নিয়া ধর্মীয় আর্টিকেল তেমন পাই না বা পেলেও সেটা এক কথায় ফুল স্টপ- রং থিউরী।
কিন্তু পবিত্র কোরআনেও তো প্রেমের কথা বলা হয়েছে। সেটা নিয়ে গানও হয়েছে-
প্রেম কইরাছে ইউসুফ নবী যার প্রেমে জুলেখা বিবি গো… ও সে প্রেমের দায়ে জেল খাটিল তবুও সে প্রেম ছাড়লো না দরদী, প্রেমের মরা জলে ডুবে না -হায় রে
আহ! এমন গান যে শুনলেই মাথা অটো দুলতে থাকে। কবি, সাহিত্যিক, গীতিকারদের কল্পনার অবাধ স্বাধীনতা থাকে। যুগে যুগে “পবিত্র প্রেমের” চিন্তা-ধারনা, প্রচারনার ধারক বাহক মুলত তারাই। আর ফাইনালি তুলির শেষ আঁচরে তা পর্দায় নিয়ে আসেন পরিচালকেরা। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ লগ্নি করেন প্রযোযকেরা। চাকরির জন্য যে লবিং না করেছি মুভি বা খেলার টিকিটের জন্য তার চেয়ে ঢের বেশী লবিং করেছি।
গান থেকে পাশ কাটিয়ে সংক্ষেপে একটু দেখি পবিত্র কোরআনে ইউসুফ আঃ সম্পর্কে কি বর্ননা করা হয়েছে।
ইউসুফ আঃ এর প্রতি যারই ভালবাসা জন্মেছিল তার কারনেই তিনি বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফকে এত বেশী রূপ-লাবণ্য এবং মায়াশীল ব্যবহার দান করেছিলেন যে, যেই-ই তাকে দেখত, সেই-ই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ত। একেবারে ছোটবেলার ঘটনা এই যে –
তাঁর ফুফু তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একদন্ড চোখের আড়াল হ’তে দিতেন না। এদিকে বিপত্নীক ইয়াকূব (আঃ) মাতৃহীনা দুই শিশু পুত্রের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই অধিকতর দুর্বল এবং সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। ইতিমধ্যে ইউসুফ একটু বড় হ’লে এবং হাঁটাচলা করার মত বয়স হ’লে পিতা ইয়াকূব (আঃ) তাকে ফুফুর নিকট থেকে আনতে চাইলেন। কিন্তু ফুফু তাকে ছাড়তে নারায। ওদিকে পিতাও তাকে নিয়ে আসতে সংকল্পবদ্ধ। শুরু হ’ল পিতা ও ফুফুর মধ্যে মহববতের টানাপড়েন। ফলে ঘটে গেল এক অঘটন।
অধিক পীড়াপীড়ির কারণে ইউসুফকে যখন তার পিতার হাতে তুলে দিতেই হ’ল, তখন স্নেহান্ধ ফুফু গোপনে এক ফন্দি করলেন। তিনি স্বীয় পিতা হযরত ইসহাক্ব (আঃ)-এর নিকট থেকে যে একটা হাঁসুলি পেয়েছিলেন এবং যেটাকে অত্যন্ত মূল্যবান ও বরকতময় মনে করা হ’ত, ফুফু সেই হাঁসুলিটিকে ইউসুফ-এর কাপড়ের নীচে গোপনে বেঁধে দিলেন।
অতঃপর ইউসুফ তার পিতার সাথে চলে যাওয়ার পর ফুফু জোরেশোরে প্রচার শুরু করলেন যে, তার মূল্যবান হাঁসুলিটি চুরি হয়ে গেছে। পরে তল্লাশী করে তা ইউসুফের কাছে পাওয়া গেল। ইয়াকূবী শরী‘আতের বিধান অনুযায়ী ফুফু ইউসুফকে তার গোলাম হিসাবে রাখার অধিকার পেলেন। ইয়াকূব (আঃ)ও দ্বিরুক্তি না করে সন্তানকে তার ফুফুর হাতে পুনরায় সমর্পণ করলেন। এরপর যতদিন ফুফু জীবিত ছিলেন, ততদিন ইউসুফ তার কাছেই রইলেন। বলা বাহুল্য, শৈশবে যেমন ইউসুফ স্বীয় ফুফুর স্নেহের ফাঁদে পড়ে ‘চোর’ সাব্যস্ত হয়ে ফুফুর গোলামী করেন।
তাঁর পিতা তাকে ভালোবেসেছিলেন। পিতৃস্নেহের আধিক্যের কারণে ভ্রাতৃ হিংসায় পতিত হন এবং তাকে হত্যার চক্রান্ত হয়। পরে জঙ্গলে নিয়ে হত্যার বদলে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হয়। সেখান থেকে কোন কোন মতে তিন দিন পরে একটি পথহারা ব্যবসায়ী কাফেলার নিক্ষিপ্ত বালতিতে করে উপরে উঠে আসেন। অতঃপর ভাইদের মাধ্যমে মিসরের অর্থমন্ত্রী আযীয মিছরের নিকটে ক্রীতদাস হিসাবে স্বল্পমূল্যে বিক্রি হয়ে যান। তার গৃহে পদার্পণ করেন ও পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত হন। আযীয মিছর তার স্ত্রীকে বলল,
একে সম্মানজনকভাবে থাকার ব্যবস্থা কর। সম্ভবতঃ সে আমাদের কল্যাণে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করে নেব। এভাবে আমরা ইউসুফকে সেদেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম (ইউসুফ ১২/২১)।
কিন্তু যৌবনেই তিনি আযীযের স্ত্রী যোলায়খার খারাপ-নযরে পড়েন।অতঃপর সেখান থেকে ব্যভিচার চেষ্টার মিথ্যা অপবাদে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।
‘হে আমার পালনকর্তা! এরা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান জানাচ্ছে, তার চাইতে কারাগারই আমার নিকটে অধিক পচ্ছন্দনীয়। (হে আল্লাহ!) যদি তুমি এদের চক্রান্তকে আমার থেকে ফিরিয়ে না নাও, তবে আমি (হয়ত)  তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তার প্রার্থনা কবুল করলেন ও তাদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (ইউসুফ ১২/৩৩-৩৪)।
ইউসুফ আঃ এর প্রার্থনায় ‘আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব’ কথার মধ্যে এ সত্য ফুটে উঠেছে যে, নবীগণ মানুষ ছিলেন এবং মনুষ্যসুলভ স্বাভাবিক প্রবণতা তাদের মধ্যেও ছিল। তবে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও ব্যবস্থাধীনে তাঁরা যাবতীয় কবীরা গোনাহ হ’তে মুক্ত থাকেন এবং নিষ্পাপ থাকেন। বেগানা নারী ও পুরুষের মাঝে চৌম্বিক আকর্ষণ এটা আল্লাহ সৃষ্ট প্রবণতা, যা অপরিহার্য। আল্লাহ তার দো‘আ কবুল করলেন এবং তাদের চক্রান্তকে হটিয়ে দিলেন (ইউসুফ ১২/২৩-২৪)। এতে বুঝা যায় যে, চক্রান্তটা একপক্ষীয় ছিল এবং তাতে ইউসুফ আঃ এর লেশমাত্র সম্পৃক্ততা ছিল না।
অনেক বছর কারাগারে থাকার পর বাদশাহর স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের অসীলায় তিনি বেকসূর খালাস পান।
উল্লেখ্য যে ইউসুফ আঃ স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করতেন। কিন্তু  তিনি নিজেকে ভবিষ্যদ্বক্তা বলে পেশ করেন নি। স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের ঘটনাকে তিনি বলেছেন ‘এ জ্ঞান আমার পালনকর্তা আমাকে দান করেছেন’ (ইউসুফ ১২/৩৭)
দীর্ঘ কারাভোগের দুঃসহ যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে ইউসুফ (আঃ) নিশ্চয়ই মুক্তির জন্য উন্মুখ ছিলেন। কিন্তু বাদশাহর পক্ষ থেকে মুক্তির নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও তিনি দূতকে ফেরত দিলেন। এর কারণ এই যে, কারামুক্তির চাইতে তার উপরে আপতিত অপবাদ মুক্তিকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ইউসুফ (আঃ) সেকারণেই ঘটনার মূলে যারা ছিল, তাদের অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন।
 ‘অতঃপর যখন বাদশাহর দূত তার কাছে পৌঁছলো, তখন ইউসুফ তাকে বলল, তুমি তোমার বাদশাহর কাছে ফিরে যাও এবং তাঁকে জিজ্ঞেস কর যে, নগরীর সেই মহিলাদের খবর কি? যারা নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল। আমার পালনকর্তা তো তাদের ছলনা সবই জানেন’ (ইউসুফ ১২/৫০)।
তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, জেল থেকে বের হওয়ার আগেই বাদশাহ বা ‘আযীযে মিছর তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ মুক্ত কি-না সেটা জেনে নেওয়া এবং ঐ মহিলাদের মুখ দিয়ে তার নির্দোষিতার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়া।
আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে ইউসুফ (আঃ) অনুরূপ পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন বাদশাহও তাঁর পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হৌন।
ইউসুফের এই সাহসী আচরণে অভিভূত হয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেন,
‘নিশ্চয়ই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির পুত্র সম্ভ্রান্ত, তার পুত্র সম্ভ্রান্ত, তার পুত্র সম্ভ্রান্ত- (তাঁরা হ’লেন) ইবরাহীমের পুত্র ইসহাক্ব, তাঁর পুত্র ইয়াকূব ও তাঁর পুত্র ইউসুফ। যদি আমি অতদিন কারাগারে থাকতাম, যতদিন তিনি ছিলেন, তাহ’লে বাদশাহর  দূত  প্রথমবার  আসার  সাথে সাথে আমি তার প্রস্তাব কবুল করতাম’। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা ইউসুফ ৫০ আয়াতটি পাঠ করেন’। তিরমিযী হা/৩৩৩২ ‘তাফসীর’ অধ্যায় ১৩ অনুচ্ছেদ ‘সূরা ইউসুফ’; ছহীহ তিরমিযী   হা/২৪৯০ সনদ হাসান; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭০৫ 
এভাবে আযীয-পত্নী ও নগরীর মহিলারা যখন বাস্তব ঘটনা স্বীকার করল, তখন বাদশাহ নির্দেশ দিলেন, ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এস। কুরআনের ভাষায়
‘বাদশাহ বলল, তাকে তোমরা আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার নিজের জন্য একান্ত সহচর করে নেব। অতঃপর যখন বাদশাহ ইউসুফের সাথে মতবিনিময় করলেন, তখন তিনি তাকে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আজ থেকে আমাদের নিকট বিশ্বস্ত ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানের অধিকারী’(ইউসুফ ১২/৫৪)।
“প্রেম কইরাছে ইউসুফ নবী যার প্রেমে জুলেখা বিবি গো”
কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বাইরে সকল বক্তব্যের উৎস হ’ল ইস্রাঈলী বর্ণনা সমূহ। সেখানে বক্তব্যের ভিন্নতার কারণেই মুসলিম ঐতিহাসিকদের বক্তব্যে ভিন্নতা এসেছে। এই সঙ্গে এটাও জানা আবশ্যক যে, ইহুদীরা ছিল আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকারকারী, অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যাকারী, আল্লাহর কিতাবসমূহকে বিকৃতকারী ও তার মাধ্যমে দুনিয়া উপার্জনকারী এবং নবীগণের চরিত্র হননকারী। বিশেষ করে ইউসুফ, দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা ও তাঁর মায়ের উপরে যে ধরনের জঘন্য অপবাদ সমূহ তারা রটনা করেছে, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। অতএব ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে তাদের বর্ণিত অভব্য ও আপত্তিকর বিষয়াবলী থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। ‘পবিত্র প্রেম’ থিউরী  ছিল এক বিরাট ভুল আর ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে যা উপস্থাপন করলাম তার মধ্যেও যদি ভুল ভ্রান্তি থেকে থাকে তবে আমি আশা করি আল্লাহ ক্ষমাশীল।