Archive for May, 2012

যৌতুক লেন-দেন বৈবাহিক সম্পর্ককে শিথিল করে

বিয়ে-শাদী এমন একটি পবিত্র বন্ধন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার ফলে সুস্থ, সুসংহত এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে জীবন-যাপন করার নিশ্চয়তা লাভ করে সমাজ। সুস্থ পরিবেশের প্রথম ধাপই হচ্ছে সংসার জীবন। শৈশবে পিতা-মাতার স্নেহ বন্ধন কাটিয়ে কৈশোরে পরবর্তীকাল অর্থাৎ যৌবনে নারী-পুরুষে বিয়ে বন্ধনের মাধ্যমে সংসার ধর্মে পদার্পণ করে। অথচ এই শান্তিপূর্ণ বিয়ে বন্ধনের মাঝে অস্বস্তিকর যে ব্যবস্থাটি আমাদের সমাজ শক্তভাবে আসন গেড়েছে- তা’হলো বিয়ে ব্যবস্থায় যৌতুক প্রথা।

কালের আবর্তে সমাজে এই যৌতুক ও পণপ্রথার জন্ম। এতে ইসলামে আল্লাহর নির্দেশিত বিয়ে প্রথা চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যৌতুকের ভয়াল গ্রাসে পিতা-মাতা হয়েছে সর্বশ্বান্ত ও কন্যাদায় গ্রস্ত। ইসলামে যৌতুক লেন দেনের স্থান নেই। প্রাক ইসলামিক যুগে কন্যা সন্তানকে পিতৃ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হতো। তাই পিতার সম্পত্তির একটা অংশ উপহার হিসাবে বিয়েতে প্রদান করা হতো। এই অনৈসলামিক বিধি ব্যবস্থা ও বিয়ে কর্মকান্ড থেকেই যৌতুক প্রথার উৎসারণ। অন্যদিকে আমাদের মুসলিম সমাজে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী নববধূর দ্রব্য সামগ্রী প্রথম পিতৃ গৃহ থেকে স্বামীর গৃহে গমনকালে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম গহনাপাতি দান জেহজ রূপে প্রদান করা হয়। এখানে শর্ত জরবদস্তি কিংবা দর কষাকষির কোন বালাই নেই। স্ব-ইচ্ছায় ও সুন্তষ্ট চিত্তে এসব দান-জেহাজ দেয়া হয়ে থাকে।
এছাড়া ইসলামে বিয়ে বন্ধনে মোহরানার গুরুত্ব অনেক। এটি ইসলামের জন্ম থেকেই মুসলীম সমাজে কড়াকড়িভাবে আরোপিত। মোহরানা কন্যার প্রাপ্য। এই মোহরানা কেবল বর কর্তৃক অনেকে স্বেচ্ছাকৃত উপহার হিসাবে প্রদান করা হয় বা স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা নারী দিগকে মোহরানা প্রদান করো, সূরা নেসায় বলা হয়েছে, পুরুষরা নারীদের ভরণ পোষণ, লালন-পালন সংরক্ষণ তথা সবকিছুর জন্য দায়ী। আল-কোরআনে আরো সুস্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে কোন কিছু দেয়াই রীতি সংগতভাবে বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে মোতৃরানা নির্ধারণি অতি অপরিহার্য। পবিত্র কোরআন, হাদীস এবং ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের মতে, বিয়ে-শাদীতে মোহরানা প্রদান অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধে মালে গণীমতের অংশ রূপে হযরত আলী (রাঃ) যে বর্মটি পেয়েছিলেন তা বিক্রয় করে তিনি একশত পঁচিশ দেরহাম হযরত ফাতেমা (রাঃ) কে মোহরানা হিসাবে প্রদান করেন। হযরত আলী (রাঃ)-এর মোহরানা দেয়ার মতো কোন সম্পদ ছিল না।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মানব সমাজ আজ বিয়ে শাদীতে যৌতুকের শিকারে পড়ে যে বিষ্ময় তথা অভিশপ্ত, কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে চলেছে তা বলাই বাহুল্য। যৌতুক গ্রহণ ও প্রদান দণ্ডনীয় আইন থাকা সত্ত্বেও (অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও) এর ফাঁকে ফাঁকে যৌতুকী বিয়ে সম্পাদিত হচ্ছে। পরিণামে মা বোন হচ্ছে লাঞ্ছিত অনেকেই করছে আত্মহত্যা, চলছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। যা অতীব দুঃখজনক। তাই আমি দেশের বৃহত্তর আলেম সমাজ নারী, ইমাম, পীর-মাশায়েখ এবং ইসলামী সামাজিক সংগঠনসমূহ তথা সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করছি।

(১) যৌতুক একটি বি-জাতীয় প্রচলন ও নারী নির্যাতনমূলক এক অভিশপ্ত প্রথা। এর বিরুদ্ধে গড়ে তোলার জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
(২) যৌতুক লেন-দেন হয় এমন বিয়েতে কালেমা বা খুতবা পাঠ না করিয়ে সামাজিকভাবে যৌতুকী বিয়ে বয়কট করতে হবে।
(৩) ওয়াজ মাহফিল ও জুমআর খুতবার সময় যৌতুক যে শরীয়ত পরিপন্থি কু-প্রথা এবং এর কুফল ও পরিণতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অভিহিত করাও যৌতুক বর্জন করার প্রতি মন-মানসিকতা তৈরি করা।
(৪) নিজ নিজ এলাকার সর্বস্তরের সমাজ কর্মীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী যৌতুক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে।
(৫) যৌতুক বিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের দাবী বিশেষ করে কবিন নামা ফরমে যৌতুকের কোন দাবী নাই এই মর্মে আদালতগ্রাহ্য হলফ নামায় স্বাড়্গর দানের দারা প্রবর্ত্তনের দাবী সরকারের কাছে তুলতে হবে।
(৬)বেতার ও টিভি চ্যানেলসমূহে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা ব্যাপকতর করতে হবে। এবং এর পরিণতিও কুফল সম্পর্কে জনসমড়্গে তুলে ধরতে হবে।
(৭) এছাড়া অবিবাহিত শিক্ষিত যুবক দ্বারা যৌতুক লেনদেনকে চরম ঘৃণা করে তারা সমাজে যৌতুক বিহীন বিয়ে করে সমাজে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।
(৮) এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, বিয়ে-শাদী মানব জীবনের একটি পবিত্রতম শুভ কাজ। ধর্মীয় নীতিমালায় যৌতুক বিয়ে শাদীর কোন স্থান নেই। যৌতুকী বিয়ে সম্পূর্ণ পরিহারযোগ্য। অতএব, দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, মসজিদের ইমাম, কাজীসহ সুধী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক সাংবাদিক তথা দেশের প্রতিটি সচেতনশীল নাগরিকের উচিত, এই অশুভ চরম ঘৃণিত পরিহার- যোগ্য অভিশপ্ত কু-প্রথার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনমানসিকতা গড়ে তোলা এবং এ দেশের পবিত্র ভূমি হতে যৌতুক শব্দটি চিরতরে বিদায় দেয়ার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে জোর আহ্বান জানাচ্ছি।

উপসংহারে বলতে চাই, আসুন আল্লাহ ও পরোকালে ভয় রেখে বিয়ে-শাদীতে যৌতুক লেন-দেন থেকে বিরত থাকি।

মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার

http://islamicbanglabd.blogspot.com/2009/01/blog-post_7556.html

প্রযুক্তি মুসলমানদের হারানো সম্পদ

আধুনিক যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যারা যত সমৃদ্ধ তারা তত উন্নত ও শক্তিধর। বর্তমানে মুসলমানরা পৃথিবীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে দ্বিতীয় হলেও বাস্তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
অথচ বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, চিকিৎসা, সাহিত্যসহ আরো অনেক শাস্ত্রে মুসলমানরাই সর্বপ্রথম অগাধ জ্ঞান লাভ করেছিল। মুসা আল খাওয়ারিজমি, ইবনেসিনা, জাবির ইবনে হাইয়ান, আবু বকর আল রামি, হাসান ইবন হাইসাম, আল বিরুনি, ইমাম বোখারি, ইবন জারির তাবারি, ইমাম গাজ্‌জালি, ওমর খৈয়াম, কবি ফেরদৌস প্রমুখ ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু বর্তমান মুসলমানরা জ্ঞান আহরণের অভাবে কুসংস্কারসহ বিভিন্ন গোঁড়ামির কারণে সেসব ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছেন। মহানবী সাঃ-এর ইন্তেকালের পর তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে আরো মহিমান্বিত করে তোলেন। জ্ঞানের দীপশিখা হাতে নিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন। প্রতিষ্ঠা করেন অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞানাগার। স্রষ্টা জীবন-প্রকৃতি সব কিছু নিয়েই গবেষণা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
‘তোমরা যে বীজ বপন করো সে বিষয়ে ভেবেছ কি?’ (সূরা ওয়াকিয়া-৬৩)।
‘তোমরা যে পানি পান করো সে বিষয়ে চিন্তা করেছ কি?’ ‘(সূরা ওয়াকিয়া-৬৮)।
‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে এবং দিন ও রাতের আর্বতনে সেসব বুদ্ধিমান লোকদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে, যারা উঠতে বসতে ও শুতে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং গঠন সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণা করে। তারা বলে ওঠে হে আল্লাহ, তুমি এর কোনো কিছু বৃথা সৃষ্টি করোনি।’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৯০-১৯১)।
মানব কল্যাণের বাহক সব ধরনের এলেমই জরুরি। মানবতার কল্যাণ হবে এমন সব ধরনের এলেমই ইসলামে কাম্য। ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ।’ ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করো।’ মহানবী সাঃ-এর বাণী সবার জন্য প্রযোজ্য।
তাই ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ ব্যবহারিক জীবনের জ্ঞান অর্জনও অতীব জরুরি। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম শিক্ষাদীক্ষায় বেশি প্রসার ঘটেছিল স্পেন ও ইরাকের বাগদাদে। কিন্তু এখন সেসব দেশের মুসলমানদের কাছেও শিক্ষা-দীক্ষা অবহেলার বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে ইরান ও মালয়েশিয়ার মতো কয়েকটি দেশ ছাড়া আর সব মুসলিম দেশের অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। গ্রহ-গ্রহান্তরে বিভিন্ন মহাশূন্যযান প্রেরণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মহাশূন্যে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে আমেরিকা, রাশিয়া। চীন ও জাপান প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যে অভাবনীয় আধিপত্য বিস্তার করছে অথচ মুসলিম দেশগুলোর কোনো বিষয়েই উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস, তেল, ইউরেনিয়াম থাকা সত্ত্বেও উন্নত প্রযুক্তির অভাবে বাংলাদেশ গরিব দেশ। যেমন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ আইভরি কোস্ট, ইথিওপিয়া, সিয়েরালিওন, সোমালিয়ায় অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি নেই বিধায় গরিব দেশের তালিকায় পড়ে রয়েছে। এ দিকে প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন না থাকলেও উন্নত প্রযুক্তি থাকার কারণে সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি প্রভৃতি দেশ অনেক উন্নত। বর্তমানে চীন ও জাপানের প্রযুক্তি সবচেয়ে উন্নত। তাই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে যে পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হয় জাপানে একই পরিমাণ জমিতে চার গুণ আর চীনে তিন গুণ ফসল উৎপন্ন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যে ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে তা উঠাতে পারলে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম একটি ধনী দেশে পরিণত হবে। কিন্তু উঠাবে কিভাবে, আমাদের তো সে রকম প্রযুক্তি নেই। বরং পাট শিল্পের মতো বিশাল শিল্পকে আমরা প্রযুক্তির অভাবে ধ্বংস করে ফেলেছি। এভাবে চললে বাংলাদেশসহ সব মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধ্য। এ দোষ কার! স্রষ্টার, না আমাদের! মুসলমানরা বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে কিন্তু চেষ্টা, পরিশ্রম ও গবেষণা করে না। মসজিদে, মাদ্রাসায় দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো ভূমিকা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রতি কোনো উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করা যায় না। অলস, অকর্মণ্য আর পরনির্ভরশীল হওয়ার শিক্ষা ঠিকই চলছে। ইহকালের বাস্তবতাকে ভুলে পরকালের সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছে। ফলে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, খেলাধুলা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছে।
ইবাদতের উছিলায় খানকায় বা মসজিদে বসে থেকে স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা বরণ করে নিতে, লোকদের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে বা মানুষের সাহায্যের ওপর বেঁচে থাকতে বলেনি ইসলাম। অলসতা আর ভিক্ষাবৃত্তির শিক্ষা ইসলামে নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ইসলামের শিক্ষা কর্মের শিক্ষা, চিন্তা ও গবেষণার শিক্ষা।
‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আর আল্লাহর অনুগ্রহ তথা জীবিকা অন্বেষণ করো।’ (সূরা জুমআ, আয়াত-১১)। ধর্মকর্মও করতে হবে আবার আমলে সালেহও করতে হবে। ‘যারা ঈমান এনেছে এবং আমলে সালেহ (সৎ কাজ, ভালো কাজ বা মানবকল্যাণ) করেছে তারাই জান্নাতি।’
আমাদের মনে রাখতে হবে, আল কুরআনে প্রায় সাড়ে সাত শ’ আয়াত রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত। আজ ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মূর্খতাকে ঝেড়ে ফেলে মুসলমানদের উচিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা, গবেষণাসহ সর্ববিষয়ে অগাধ জ্ঞান লাভ করে শির উঁচু করে দাঁড়ানো। তাহলেই মুসলমানদের তাদের হারানো ঐতিহ্য, শৌর্য-বীর্য এবং ক্ষমতা ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজেরাই সচেষ্ট হতে হবে। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়।’ (সূরা জুমআ, আয়াত-১১)।

সুত্রে (সংখেপিত)
http://islamicbanglabd.blogspot.com/2008/11/blog-post_3899.html

ইসলাম ও মানবতা

সকল সৃষ্টির স্রষ্টা মহান রাব্বুল আল-আমীন এই পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা স্থলাভিষিক্তরূপে মানুষ সৃষ্টি করেছেন আর জ্ঞানদান করার কারণে তাঁর সকল সৃষ্টির ওপর মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেনঃ এই জ্ঞান দ্বারা মানুষ ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা দেখতে পারে, বুঝতে পারে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন, যেন পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কারা সঠিক-সুন্দর পথে জীবন-যাপন করে (৬৭:২)।

হে! মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রভুর নির্দেশ মেনে চলো, যিনি তোমাদের একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন আর তাদের থেকেই বহু নর ও নারী বিস্তৃত করেছেন। (৪ঃ১)।

মহানবী (সাঃ) বলেছেনঃ তোমরা সবাই আদম সন্তান আর আদমকে বানানো হয়েছে মাটি দ্বারা। সুতরাং মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই।

আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয় আল্লাহর নির্দেশ অধিক পালন করে, মন্দ কাজ পরিহার করে (৪৯ঃ১৩)।

ইসলামী দর্শনানুযায়ী মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম সালাত ও নামাযেই সে মানবতাবোধ, একথা, সৌহার্দ, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বে শিক্ষা দেয়া হয়।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর ইসলাম প্রচারের প্রারম্ভে একবার তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক বৃদ্ধ মহিলাকে বড় বোঝা বহন করে নিয়ে যেতে দেখে মহানবী (সাঃ) তার সাহায্যার্থে বোঝাটি নিজের কাঁধে নিয়ে পথ চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলেন, মা, তুমি এত বড় বোঝা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? বৃদ্ধা জানালেন, তার এলাকায় মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি বেরিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে যার দেখা হয়, সে-ই পিতৃধর্ম হারিয়ে ফেলে। তাই বৃদ্ধ বয়সে পিতৃধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধা এই এলাকা ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছেন। মহানবী (সাঃ) আর কিছু না বলে বৃদ্ধাকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় চাইলে বৃদ্ধা মহানবী (সাঃ)-এর মানবতা ও মহানুভবতায় বিমুগ্ধ হয়ে তার নাম ও পরিচয় জানতে চান। মহানবী (সাঃ) মিথ্যা বলতে জানতেন না এবং কখনো মিথ্যা বলেননি। তিনি বললেন, আমার নাম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ। বৃদ্ধা মহানবী (সাঃ)-এর মমতা ও মানবতা প্রেমে মুগ্ধ হন এবং বুঝতে পারেন এমন চরিত্র সত্য নবী ছাড়া কারো হতে পারে না। তিনি মহানবী (সাঃ)-এর সাক্ষাৎধন্য হয়ে মহাসত্য ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেন।

ধর্ম তথা ইসলাম মানুষের কল্যাণের জন্য দেয়া হয়েছে। মানুষের জন্যই ধর্ম বা ইসলাম। পৃথিবীর সব ধর্মই তো মনুষ্যত্ব পেশায় শান্তির কথা বলে এবং মানবতার বাণী শোনায়। আমাদের সমাজে তথা বিশ্বসমাজে সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করলে মানবসমাজে অশান্তি থাকতে পারে না। কারণ সকল ধর্মই ভালো কাজ করা, মন্দ পরিহার করা এক কথায় মানবতার শিক্ষা দেয়। অথচ পৃথিবীর বহু ধর্মের পার্থক্যের কারণে তথাকথিত মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, সম্পদ লুট করছে, এমনকি মা বোনদের সম্ভ্রম পর্যন্ত লুটছে।

অথচ আল্লাহ তাআলা এ পৃথিবীর সবকিছুই বানিয়েছেন মানুষের জন্য। বলেছেনঃ তিনি মহান আল্লাহ যিনি মানুষের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন (২ঃ২৯)। আর মানুষ বানিয়েছেন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে, তাঁকে জানতে ও তাঁর নির্দেশিত পথে পরিচালিত হয়ে বাহ্যিক ও আত্মার শান্তি লাভ করতে। এ শান্তির জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধতা। আবার আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্য কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ঘৃণা, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি ব্যাধিমুক্ত হয়ে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। আর মানবপ্রেম তথা সৃষ্টিপ্রেম ছাড়া এসব নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না।

ইসলামের মানবতার শিক্ষা হলো সংঘাত নয় সমঝোতা, সাম্প্রদায়িকতা নয় সহমর্মিতা, যুদ্ধ নয় শান্তি, পরনিন্দা নয় আত্মসমালোচনা, কুৎসা নয় আত্মশুদ্ধি, অহঙ্কার নয় বিনম্রতা, শত্রতা নয় বন্ধুত্ব, পরশ্রীকাতরতা নয়, ভ্রাতৃত্ব, জবরদস্তি নয় ন্যায় পরায়নতা, অমঙ্গল কামনা নয় সমবেদনা, ক্ষতিসাধন নয় কল্যাণ কামনা এবং হিংস্রতা ও পশুত্ব নয় সদাচরণ ও মানবতা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে মানবতাবোধে উদ্‌ভাসিত হয়ে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ ও শান্তি লাভ করার শক্তি দান করুন।

প্রফেসরড আ ন ম রইছ উদ্দিন
কিছুটা সংক্ষিপ্ত
http://islamicbanglabd.blogspot.com/2009/02/blog-post_20.html

আবু যর রাঃ ইসলামী কায়দায় রাসূল (সাঃ)-কে সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন

হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর একজন প্রিয় সাহাবী। তার পূর্ব পরিচিত ছিল এরূপঃ বাইরের জগতের সাথে মক্কার সংযুক্তি ঘটিয়েছে যে, আদ্দান উপত্যকাটি, সেখানেই ছিল গিফার গোত্রের বসতি। জুনদুব ইবনে জুনাদাহ আবু যর নামেই যিনি পরিচিত-তিনিও ছিলেন এ কবীলার সন্তান। বাল্যকাল থেকেই তিনি অসীম সাহস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টির জন্য ছিলেন সকলের থেকে স্বতন্ত্র। জাহেলী যুগে জীবনের প্রথম ভাগে তার পেশাও ছিল রাহাজানি। গিফার গোত্রের একজন দুঃসাহসী ডাকাত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে তার জীবনে ঘটে যায় এক পরিবর্তন। তার গোত্রীয় লোকেরা এক আল্লাহ ছাড়া সকল মূর্তির পূজা করত। তাতে তিনি গভীর ব্যথা অনুভব করতেন। কিছুদিন পরেই তিনি নিজেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন।
তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। ইবনে হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়, তিনি তার গোত্রের সাথে বসবাস করছিলেন। একদিন সংবাদ পেলেন মক্কায় এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে; তাই তিনি তার ভাই আনিসকে ডেকে বললেনঃ তুমি একটু মক্কায় যাবে। সেখানে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন এবং আসমান থেকে তার কাছে ওহী আসে বলে প্রচার করে থাকেন; তার সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে, তার মুখের কিছু কথা শুনবে। তারপর ফিরে এসে আমাকে অবহিত করবে। আনিস মক্কায় চলে গেলেন। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তার মুখ নিঃসৃত বাণী শ্রবণ করে নিজ গোত্রে ফিরে এলেন। আবু যর (রাঃ) খবর পেয়ে তখনই ছুটে গেলেন আনিসের কাছে। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে নতুন নবী সম্পর্কে নানান কথা তাকে জিজ্ঞেস করলেন। আনিস বললেনঃ কসম আল্লাহর। আমি তো লোকটি দেখলাম, মানুষকে তিনি মহৎ চরিত্রের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। আর এমন কথা বলেন যা কাব্য বলেও মনে হল না। মানুষ তার সম্পর্কে কি বলাবলি করে? কেউ বলে- তিনি একজন যাদুকর, কেউ বলে গণক, আবার কেউ বলে কবি। আল্লাহর কসম। তুমি আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারলে না। আমার আকাঙক্ষাও পূরণ করতে সক্ষম হলে না। তুমি কি পারবে আমার পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে, যাতে আমি মক্কায় গিয়ে স্বচক্ষেই তার অবস্থা দেখে আসতে পারি? তবে আপনি মক্কাবাসীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।

পরদিন সকালে আবুযর চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। সাথে নিলেন কিছু পাথেয় ও এক মশক পানি। সর্বদা তিনি শংকিত, ভীত চকিত। কোন ব্যক্তির কাছে মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞেস করা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। কারণ, তার জানা নেই এ জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিটি মুহাম্মদের বন্ধু না শত্রম্ন? দিনটি কেটে গেল। রাতের আঁধার নেমে এল। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তিনি শুয়ে পড়লেন মাসজিদুল হারামের এক কোণে। আলী ইবন আবী তালিব যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়েই। দেখে তিনি বুঝতে পারলেন লোকটি মুসাফির। ডাকলেন, আসুন আমার বাড়িতে। আবুযর গেলেন তার সাথে এবং সেখানেই রাতটি কাটিয়ে দিলেন।

সকালবেলা পানির মশক ও খাবারের পুঁটলিটি হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলেন মাসজিদে। তবে দু’জনের একজন ও একে অপরকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। পরের দিনটিও কেটে গেল। কিন্তু নবীর সাথে পরিচয় হল না। আজো মাসজিদে শুয়ে পড়লেন। আজো আলী (রাঃ) আবার সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। বললেনঃ ব্যাপার কি, লোকটি আজো তার গন্তব্যস্থল চিনতে পারেনি? তিনি তাকেই আবার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এ রাতটি সেখানে কেটে গেল। এদিনও কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। একইভাবে তৃতীয় রাতটি নেমে এল। আলী (রাঃ) আজ বললেন- বলুন তো আপনি কি উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন? তিনি বললেন, যদি আমার কাছে অঙ্গীকার করেন, আমার কাঙিক্ষত বিষয়ের দিকে আপনি আমাকে পথ দেখাবেন, তাহলে আমি বলতে পারি। আলী (রাঃ) অঙ্গীকার করলেন। আবু যর বললেনঃ আমি অনেক দূর থেকেই মক্কায় এসেছি নতুন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তিনি যেসব কথা বলেন, তার কিছু শুনতে। আলীর (রাঃ) মুখ-মণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, আল্লাহর কসম, তিনি নিশ্চিত সত্য নবী। একথা বলে তিনি নানাভাবে নবীর (সাঃ) পরিচয় দিলেন। তিনি আরো বললেন, সকালে আমি যেখানেই যাই, আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি আপনার জন্য আশংকাজনক কোনকিছু লক্ষ্য করি তাহলে প্রস্রাবের ভান করে দাঁড়িয়ে যাব। আবার যখন চলব, আমাকে অনুসরণ করে চলতে থাকবেন। এভাবে আমি যেখানে প্রবেশ করি আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন। প্রিয়নবী দর্শন লাভ ও তার ওপর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ শ্রবণ করার প্রবল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠায় আবু যর সারাটা রাত বিছানায় স্থির হতে পারলেন না। পরদিন সকালে মেহমান সাথে করে আলী (রাঃ) চললেন রাসূল (সাঃ)-এর বাড়ির দিকে। আবু যর তার পেছনে পেছনে। পথের আশপাশের কোনকিছুর প্রতি তার ভ্রম্নক্ষেপ নেই। এভাবে তারা পৌঁছলেন রাসূল (সাঃ)-এর কাছে। আবু যর সালাম করলেন। আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ। রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন, ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ। এভাবে আবু যর সর্বপ্রথম ইসলামী কায়দায় রাসূল (সাঃ)-কে সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর সালাম বিনিময়ের এ পদ্ধতিই গৃহীত ও প্রচারিত হয়।

রাসূল (সাঃ) আবু যরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শোনালেন। সেখানে বসেই আবু যর কালেমায়ে তাওহীদের পাঠ করে নতুন দ্বীনের মধ্যে প্রবেশের ঘোষণা দিলেন এবং তার সাথে সাথেই তাওহীদের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য ওঠে-পড়ে লেগে গেলেন। আবু যর (রাঃ) বলেন-আমি মসজিদে এলাম। কুরাইশরা তখন একত্রে বসে গুজব করছে। আমি তাদের মাঝে হাযির হয়ে যতদূর সম্ভব উচ্চকণ্ঠে সম্বোধন করে বললাম, কুরাইশ গোত্রের লোকেরা আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল। এ কথা বলার সাথে সাথেই কুরাইশরা ভীত-চকিত হয়ে পড়ল এবং একযোগে সবাই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং আমাকে বেদম প্রহার শুরু করল। রাসূলের চাচা- আব্বাস আমাকে চিনতে পেরে তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করলেন। একটু সুস্থ হয়ে আমি রাসূল (সাঃ)-এর কাছে ফিরে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, তোমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলাম না? বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! নিজের মধ্যে এক প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছিলাম। সে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি মাত্র।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালীন আল-ইসাবা গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তখন লোকেরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে ইতস্ততঃ প্রকাশ করতে লাগল। কোন ব্যক্তিকে দেখা না গেলে সাহাবীরা বলতেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ অমুক আসেনি। জবাবে তিনি বলতেন, যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ হয়, তাহলে শিগগিরই আল্লাহ তাকে তোমাদের সাথে মিলিত করবেন। এক সময় আবুযরের নামটি উল্লেখ করে বলা হল, সেও পিঠটান দিয়েছে।

প্রকৃত ঘটনা হল, তার উটের ছিল মন্থর গতি। প্রথমে তিনি উটটিকে দ্রুত চালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে নিজের কাঁধে উঠিয়ে হাঁটা শুরু করেন এবং অগ্রবর্তী মানজিলে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন। এক সাহাবী দূর থেকে তাকে দেখে বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ রাস্তা দিয়ে কে একজন যেন আসছে। তিনি বললেনঃ আবু যরই হবে। লোকেরা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে চিনতে পারল এবং বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, এতো আবু যরই। তিনি বললেন, আল্লাহ আবু যরের ওপর রহমত করুন। সে একাকী চলে, একাকীই মরবে, কিয়ামতের দিন একাই উঠবে। (তারীখুল ইসলামঃ আল্লামা যাহাবী ৩য় খণ্ড)।

রাসূল (সাঃ)-এর দ্বিতীয় ভবিষ্যৎ বাণীটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। হযরত আবু যর ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই সরল, সাদাসিধে, দুনিয়াবিরাগী ও নির্জনতা প্রিয় স্বভাবের। এ কারণে রাসূল (সাঃ) তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন- ‘মসিরুল ইসলাম।’ রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর তিনি দুনিয়ার সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন। প্রিয় নবীর বিচ্ছেদে তাঁর অন্তর অভ্যন্তরে যে দাহ শুরু হয়েছিল তা আর কখনো প্রশমিত হয়নি।

হযরত আবু যর (রাঃ) এর ওফাতের কাহিনীটিও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। হিজরী ৩১ মতান্তরে ৩২ সনে তিনি রাবজার মরুভূমিতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর সহধর্মিনী তাঁর অন্তিমকালীন অবস্থার বর্ণনা করেছেন এভাবে- আবু যরের অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে পড়ল, আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, কাঁদছ কেন? বললামঃ এক নির্জন মরুভূমিতে আপনি পরকালের দিকে যাত্রা করছেন। এখানে আমার ও আপনার ব্যবহ্নত বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত এমন বস্ত্র নেই যা দ্বারা আপনার কাফন দেয়া যেতে পারে। তিনি বললেনঃ কান্না থামাও। তোমাকে একটি সুসংবাদ দিচ্ছি। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে একজন মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মরণের সময় মুসলিমদের একটি দল সেখানে অকস্মাৎ উপস্থিত হবে। আমি ছাড়া সে লোকগুলোর সকলেই লোকালয়ে ইন্তেকাল করেছে। এখন মাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সে ব্যক্তি আমিই।

সেই কাফেলাটি হল ইয়ামেনী। তারা কুফা থেকে এসেছিল। আর তাদের সাথে ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)। এ কাফিলার সাথে তিনি ইরাক যাচ্ছিলেন। তিনিই আবু যরের জানাযার ইমামতি করেন এবং সকলে মিলে তাকে রাবজার মরুভূমিতে দাফন করেন।

শেখ হুমায়ুন কবির, খবরটোয়েন্টিফোর.কম:
http://www.khobor24.com/?p=39395