মহান আল্লাহ্‌তাআলার গুণাবলী ও পরিচয়

মহান স্রষ্টা ও সৃষ্টি এবং আরদ ও মা’বুদের মধ্যে বড়ই মধুর ও নিবিড় সুসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। আরদ হল দাস, বান্দা এবং মা’বুদ হল যিনি বান্দা বা দাসের নিকট সকল প্রকার আনুগত্য বা দাস্বত্বের অধিকার পাওয়ার যোগ্য। যার আদেশের বিন্দু পরিমাণ ও অমান্য বা অনাগ্রহ দেখাবার ক্ষমতা তার বান্দার নেই। আরদ ও মা’বুদের সম্পর্কোন্নয়নের বড় ধরনের মাধ্যমহল তার (মা’বুদের) যিকির বা স্মরণ।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তরসমূহ আল্লাহর যিকির (স্মরণ) দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়। (সূরা রা’দ-২৮) আর এই আত্মার শান্তিই মানবজাতির তার প্রভুর নিকর কাম্য বা প্রত্যাশা। যারা তাদের মহান আল্লাহর (মাঃবুদের) নিকট এই প্রত্যাশা পূরণে আগ্রহী তাদের উচিত হবে যে, তাদের মহান প্রভু আল্লাহ তাআলার গুণাবলী ও পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। তিনি তার পরিচয় ও গুনাবলী মহাগ্রন্থ আলকুরআনে যথাস্থানে পর্যায়ক্রমে সুন্দর ও সুবিন্যস্তাকারে বিবৃত করেছেন। তার এখানে বিশেষভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে আল্লাহ। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য (ইবাদতের যোগ্য) নেই। তিনি চিরজীবী, চিরস্থায়ী। তাকে তন্দ্রা বা নিন্দ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তার। কে আছে, যে তার অনুমতি ছাড়া তার কাছে সুপারিশ করবে? তাদের (মানুষের) সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত আছেন। যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তার জ্ঞানের কিছুই তারা (মানুষেরা) আয়ত্ত করতে সক্ষম হয় না। তার আসন আকাশ ও পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত, আর ওদের (আকাশ ও পৃথিবীর) রক্ষণাবেক্ষণে তিনি ক্লান্ত হন না, তিনি অতি উচ্চ ও অতি মহান। (সূরা বাকারা-২৫৫)

“সমস্ত প্রশংসা আল্রাহ তা’আলারই জন্য যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক, যিনি পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু। যিনি বিচার দিবসের (প্রতিফল দিবসের) মালিক।” (সূরা ফাতেহা-১-৪)

“বলুন, হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ্‌“ আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্যদান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, আর যাকে ইচ্ছা আপনি অপমানিত করেন। যাবতীয় কল্যাণ আপনার হাতেই নিহিত। নিশ্চয়ই আপনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। আপনি রাতকে দিনে, দিনকে রাতে পরিবর্তন করেন এবং আপনিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটান, আবার জীবন্ত থেকে মৃতের আবির্ভাব ঘটান। আপনি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ (রিযিক) দান করেন।” (আল ইমরান-২৬-২৭)

“(মহান আল্লাহ্‌) তিনি সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী, আরশের অধিপতি, তিনি তার দাসদের (বান্দাদের) মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা, স্বীয় আদেশসহ ওহী পাঠান, যাতে সে কিয়ামত দিবস সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে।” (সূরা মুমিন-১৫)।

“এবং তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়, মহান আরশের অধিকারী, তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই পরিপূর্ণ করেন।” (সূরা বুরুজ-১৪-১৬) তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও ওদের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেন, অতঃপর তিন আরশে সমাসীন হন। তিনিই দয়াময়। (সূরা ফুরকান-৫৯)

“এবং তিনিই (মহান আল্লাহ) তোমাদের জন্য রাত্রিকে আবরণস্বরূপ করেছেন এবং বিশ্রামের জন্য তোমাদের দিয়েছেন নিদ্রা এবং কর্মের জন্য দিয়েছে দিন। তিনিই স্বীয় অনুগ্রহের প্রাক্কালে সুসংবাদবাহীরূপে বায়ু প্রেরণ করেন এবং আকাশ হতে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করেন। এ (পানির) দ্বারা মৃত ভূখন্ডকে সঞ্জীবিত করার জন্য এবং অসংখ্য জীবজন্তু ও মানুষের তৃষ্ণা নিরাবণের জন্য এবং আমি এ (পানি) ওদের (জীবজন্তু ও মানুষের) মধ্যে বিতরণ করি যাতে ওরা স্মরণ করে। কিন্তু অধিকাংশ লোক কেবল অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে। তিনিই (আল্লাহ) দুইটি সাগরকে প্রবাহিত করেছেন, একটির পানি মিষ্ট, সুপেয় এবং অপরটির পানি লোনা, বক্ষ জ্বলনকারী (ক্ষারবিশিষ্ট), উভয়ের মধ্যে তিনি রেখে দিয়েছেনএক সীমারেখা, এ অনতিক্রম্য ব্যবধান এবং তিনিই মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন; পরে তিনি মানুষকে রক্তগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তোমার প্রতিপালক (মহান আল্লাহ) সর্বশক্তিমান”। (সূরা ফুরকান-৪৭-৫৪)

আল্লাহ, তিনি দুর্বল অবস্থায় তোমাদের (মানুষদের) সৃষ্টি করেন, অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তিদান করেন। (যৌবনতা ও পৌঢ়তা), অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং সর্বজ্ঞ। সর্বশক্তিমান। (সূরা রূম-৫৪)

হে মানুষ! তোমরা তো আল্লাহর মুখাপেক্ষী, কিন্তু আল্লাহ্‌ তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসাই। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের অস্তিত্ব বিলোপ করতে পারেন এবং এক নতুন সৃষ্টি অস্তিত্বে আনতে পারেন। এ আল্লাহর পক্ষে কঠিন নয়”। (সূরা ফাত্বির-১৫-১৭)

নিশ্চয়ই আসমান ও জমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং সমুদ্রে জাহাজ চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং আল্লাহতাআলা আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে জীবিত করেন এবং সকল প্রকার প্রাণী তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এবং বায়ুর দিক পরিবর্তনের মধ্যে, আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে মেঘের গমনাগমনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। (সূরা বাকারা-১৬৪)

এবং আল্লাহ্‌ তোমাদের মাতৃগর্ভ হতে এমনভাবে নির্গত করেছেন যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের দিয়েছেন শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হ্নদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা নহল-৭৮)

“এবং আমি মানুষকে, তাদের দুঃখ দৈন্য স্পর্শ করার পর, অনুগ্রহের আস্বাদ দিলে তারা তৎক্ষণাৎ আমার নিদর্শনকে বিদ্রুপ করে। বল, আল্লাহ বিদ্রুপের শাস্তিদানে আরো তৎপর”। তোমরা যে বিদ্রুপ কর তা আমার ফেরেশতাগণ লিখে রাখে। তিনি তোমাদের জলে-স্থলে ভ্রমণ করান, এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও এবং এগুলো (নৌকাগুলো) আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাসে চলতে থাকে এবং তারা (আরোহীগণ) ওতে আনন্দিত হয়, অতঃপর এগুলো (যখন) বাত্যাহত এবং চতুর্দিক হতে তরঙ্গাহত হয় এবং তারা তদ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে মনে করে, তখন তারা আল্লাহ্‌র অনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে ডেকে বলে, ‘তুমি এ হতে আমাদের ত্রাণ করলে (মুক্ত করলে) আমরা অবশ্য কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর, তিনি যখনই তাদের বিপদমুক্ত করেন তখনই তারা দেশে অন্যায়ভাবে দৌরাত্ম্য করতে থাকে। হে মানুষ” তোমাদের দৌরাত্ম্য ব‘তঃ তোমাদের নিজেদের প্রতিই হয়ে থাকে; পার্থিব জীবনের সুখভোগ করে নাও, পরে আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমরা যা করতে (তা) তোমাদের জানিয়ে দেব। (সূরা ইউনুছ-২১-২৩)

মহান আল্লাহ তার দয়া ও অনুগ্রহ সম্পর্কে বলেন, “হে আমার দাসগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিতও হবে না। তোমরাই তো আমার আয়াতে (কুরআনে) বিশ্বাস করেছিলে এবং আত্মসর্ম্পন করেছিলে; তোমরা এবং তোমাদের সহধর্মিনীগণ আনন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর। ওদের খাদ্য ও পানীয় পরিবেশন করা হবে স্বর্ণের থালা ও পানপাত্রে, সেখানে রয়েছে মন যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়, সমস্ত কিছু। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটিই জান্নাত, তোমরা তোমাদের কর্মের ফরলস্বরূপ যার অধিকারী হয়েছ। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর ফলমূল, তা থেকে তোমরা আহার করবে। (সূরা যুখ্‌রোফ-৬৮-৭৩)

বিশ্ববাসী মানবজাতির বাস্তব আচার-আচরণের ধ্যান-ধারণার রূপরেখার বর্ণনাটুকুই মহান আল্লাহর উপরোল্লেখিত বাণীসমূহে প্রস্ফুটিত হয়েছে। বাস্তবে বর্তমান বিশ্বে যে ধরনের সংকট ও সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে, তা মহান আল্লাহ সময়ে সময়ে সহজভাবে সমাধান দিয়ে দিচ্ছেন। আবার কখনো কখনো বড় ধরনের বিপদাপদ দিয়ে মানুষকে পরীক্ষার সম্মুখীন করছেন। ফলে মানবজাতি হতাশাগ্রস্ত এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পরক্ষণে আল্লাহতাআ’লা যখন বিপদাপদ হতে মুক্ত করে দেন, তখন মানুষ মনে করে, এটা আমাদের প্রাপ্য। এর সম্যক দৃশ্য পৃথিবীতে বর্তমানে দৃশ্যতঃ বিদ্যমান।

সম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সর্বোচ্চ ২০০ হতে ২৫০ কিঃ মিঃ বেগে সামুদ্রিক ঝড়-তুফান, সুনামী ও দুনিয়া কাঁপানো ভূমিকম্পে লাখ লাখ লোক প্রাণ হারাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। জলবায়ুর তাপ পরিবর্তনে দুনিয়াব্যাপী মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের দেশেও কিছুদিন পূর্বে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ দেশের এক-চতুর্থাংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ধ্বংস-স্তূপে পরিণত করেছে। তাই সর্বাবস্থায় মানবজাতির আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত এবঙ মুক্তবস্থায় সর্বদা ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করাই প্রকৃত মানবের গ্রহণযোগ্য পন্থা।

মহান সৃষ্টিকর্তা, সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক ও প্রলয়কর্তা, মহান আল্লাহ্‌তাআলার গুণের বর্ণনা কোন মাখলুক বা সৃষ্টির দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভবও সাধ্যের নয়। এ সম্পর্কে তিনি (আল্লাহ) বলেন, ইরশাদ হচ্ছে- পৃথিবীর সমুদয় বৃক্ষ যদি কলম হয় এবং এযে সমুদ্র, এর সাথে যদি আরো সাত সমুদ্রযুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও আল্লাহর গুণাবলী লিখে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহতাআলা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা লুকমান-২৭)

মুমিন মুসলিমের জীবনে মহান আল্লাহর গুণের ও ক্ষমতার পরিচয় জেনে রাখা অবশ্য করণীয়। ফলে জীবন হবে উন্নত এবং এর দ্বারা খুঁজে পাবে মুক্তির পথ। হে মহান আল্লাহ! আপনি আমাদের আপনার গুণে গুণাম্বিত করুন। আমিন

http://prothom-aloblog.com/blog/lovelu1977

Leave a comment