হাদিস শাস্ত্রের অগ্রদূত ইমাম বোখারী (রঃ)
ইমাম বোখারী (রঃ) প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ও অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। তিনি যে গ্রন্থ একবার পড়তেন সে গ্রন্থই তার মুখস্থ হয়ে যেত। পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে, তিনি ছয় কি নয় বছর বয়সে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেন। কৈশোর বয়সেই তিনি সত্তর হাজার হাদীস মুখস্থ করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ ও প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা অচিরেই সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নিজেই বলেছেন যে, আমার এক লক্ষ সহীহ এবং দু’লক্ষ গায়রে সহীহ হাদীস মুখস্থ আছে। মুহাদ্দিসগণ বিভিন্নভাবে তাঁর স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করে বিস্ময়ে হতবাক হন এবং সকলেই স্বীকার করেছেন যে, হাদীস শাস্ত্রে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। ইমাম বোখারী (রঃ) ছিলেন একজন মুত্তাকী ও পরহেযগার ব্যক্তি। রমযানের প্রথম রজনীর আগমন হলে সাথীগণ তাঁর নিকট এসে জমা হতেন। তিনি তাদেরকে নিয়ে জামা’আত করতেন। বকর ইবনে মুনীর বলেন, “আমি বোখারী (রঃ) থেকে শ্রবণ করেছি, তিনি বলেনঃ আমি আশা পোষণ করছি যে, আমি আল্লাহতা’আলার সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করব যে , আমি কারও গীবত করেছি এ হিসাবে আমাকে দিতে হবে না।” ফিরাবরী (রঃ) বলেন, আমাকে নাজ্স ইবনুল-ফাযল বর্ণনা করেছেন এবং তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান। তিনি বলেন, “আমি নবী করিম (সঃ) কে স্বপ্নে দেখলাম, তিনি তাঁর কবর থেকে বের হয়েছেন এবং মুহম্মদ ইব্ন ইসমা’ঈল তাঁর পশ্চাতে রয়েছেন। নবী কারিম (সঃ) যখনই কদম উঠাতেন তখন মুহাম্মদ তার পা উঠাতেন এবং নবী করিম (সঃ) -এর কদমের স্থানে তার কদম রাখতেন এবং তাঁর পদচিহ্নের অনুসরণ করতেন। ইমাম বোখারী (রঃ) ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার ও আল্লাহ ভীরু ব্যক্তি। পার্থিব সম্পদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আসক্তি ছিল না। আবু সা’ঈদ বকর ইব্ন মুনীর উল্লেখ করেন যে, একবার জনৈক ব্যক্তি ইমাম বোখারী (রঃ)-কে কিছু পণ্যসামগ্রী প্রদান করেন। সন্ধ্যার সময় কয়েকজন ব্যবসায়ী তাঁর নিকট আগমন করে ঐ সকল পণ্যসামগ্রী পাঁচ হাজার দিরহাম লাভ দিয়ে ক্রয় করার প্রস্তাব দেন। ইমাম বোখারী (রঃ) রাতের বেলায় তাদের ফিরে যেতে বলেন। পরদিন সকাল বেলায় অন্য কয়েকজন ব্যবসায়ী আগমন করে তাঁর কাছ থেকে দশ হাজার দিরহাম লাভ দিয়ে ঐ পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমাম বোখারী (রঃ) তাদের প্রস্তাবে রাজী হলেন না। কেননা তিনি রাত্রেই নিয়ত করেছিলন যে, ঐ পণ্যসামগ্রী তিনি প্রথমবারে আসা ব্যবসায়ীদের নিকট পাঁচ হাজার দিরহাম লাভেই বিক্রয় করবেন। তাঁর নিয়ত ভঙ্গ হোক এটি তিনি কখনই পছন্দ করতেন না। হুমায়ন ইব্ন মুহাম্মদ সমরকন্দ (রঃ) ইমাম বোখারী (রঃ) এর তিনটি বিশেষ ব্যক্তিগত গুণের কথা উল্লেখ করেনঃ তিনি ছিলেন স্বল্প ভাষী , অন্যের নিকট যা রয়েছে তার প্রতি লোভ করতেন না এবং অন্যদের কর্মকাণ্ডে তিনি আত্ননিয়োগ করতেন না। তার পূর্ণ আত্ননিয়োগ ছিল জ্ঞানের ক্ষেত্রে। মুহাম্মদ ইব্ন আবী হাতিম বলেন, আমি বোখারী (রঃ) থেকে শুনেছি, আমি আমদ ইবন আবী ‘ইয়াস-এর নিকট গমন করি। আর তখন আমার খাদ্যসামগ্রী শেষ হয়ে যায়। এমনকি আমি তখন ঘাস পাতা খেতে থাকি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কাউকে অবহিত করিনি। এমতাবস্থায় যখন তৃতীয় দিবস তখন আমার নিকট একব্যক্তি আগমন করলেন, আমি তাকে চিনি না। তিনি আমাকে দীনারের একটি থলি দিয়ে বলেলন, ‘এটি তুমি তোমার নিজের জন্য খরচ কর।’
ইমাম বোখারী (রঃ) ৫৬ বছর বয়সে নিশাপুর নামক স্থানে কিছুকাল অবস্থান করেন। সেখানে তিনি হাদিসের শিক্ষা দান করতেন। সমগ্র দেশব্যাপী তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। কিন্ত কিছু কিছু মানুষ তার সুখ্যাতিতে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠে। এমতাবস্থায় ইমাম বোখারী (রঃ) নিশাপুর হতে প্রস্থান করলেন এবং নিজ জন্মস্থান বোখারার দিকে আগমন করলেন। বোখারর জনগণ তাদের সন্তানকে নিজ দেশে ফিরে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কিন্ত কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যের শাসনকর্তার সাথে তার মনোমালিন্যের সূত্রপাত ঘটল। তখন বোখারার শাসনকর্তা ছিলেন খালিদ ইব্ন আহমদ। ইমাম বোখারী (রঃ) যখন বোখারায় আগমন করেন তখন শহরের তিন মাইল জুড়ে তার সম্মানার্থে গেট ও গুম্বুজ নির্মাণ করা হয়। শহরের জনগণ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং এতে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। জনগণ তার আগমনে দীনার, দিরহাম ও মিষ্টি বিতরণ করেন। তিনি কয়েকদিন বোখারায় অবস্থান করার পর মুহাম্মদ ইব্ন ইয়াহইয়া আয্-যুহরী বোখরার গভর্নর খালিদ ইব্ন আহমদের নিকট লিপিদ্ধ করেন, “এই ব্যক্তি সুন্নতের বিপরীত কার্যপলাপ করেছে।” বোখারার গভর্নর এই চিঠি জনগণের নিকট পাঠ করে শুনান। কিন্তু জনগণ তাঁকে ত্যাগ করতে রাজী হলেন না। এরূপ অবস্থায় গভর্নর খালিদ তাঁকে শহর ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। পরবর্তীতে গভর্নর খালিদ ইব্ন আহমদ ইমাম বোখারী (রঃ) -এর সংকলিত কিতাব অধ্যয়ন করতে ইচ্ছুক। ইমাম বোখারী (রঃ) যেন গভর্নরের বাসভবনে উপস্থিত হয়ে এই কাজ করেন। ইমাম পরিষ্কার ভাষায় উত্তর দিলেনঃ “দেখুন! আমি কখনও ইলমকে অপমানিত ও হেয় প্রতিপন্ন করতে পারব না। (লক্ষ লক্ষ গরীব জনসাধারণকে উপেক্ষা করে) এই মহান রত্ন- ইলমকে আমীর- ওমরাদের দরজার প্রত্যাশী বানাতে পারব না। অতএব আমীর সাহেব যদি ইলমের প্রতি অনুরাগী ও আকৃষ্ট হয়ে থাকেন তবে তিনি যেন আমার মসজিদ বা বাড়ীতে উপস্থিত হন। আর যদি তিনি আমার এই ব্যবস্থা অবলম্বনে অসন্তষ্ট হন এবং আমার শিক্ষাদান কাজে বাধা প্রদানের মনস্থ করেন তবে আমি সে বিষয়ে আদৌ শঙ্কিত নই। কারণ, তার দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যদি আমার এই কাজ বন্ধ হয়ে যায় তবে আমি কিয়ামতের দিন আল্লাহতা’ আলার নিকট এই বলে ক্ষমার্হ গণ্য হতে পারব যে-আমি স্বেচ্ছায় ইলম চর্চা বন্ধ করে দেইনি।” গভর্নর খালিদ উক্ত উত্তরে ইমাম বোখারী (রঃ)-এর উপর অত্যন্ত অসন্তষ্ট হলেন। তিনি বিভিন্ন ছলাকলার আশ্রয় গ্রহণ করে ইমাম বোখারী (রঃ) -কে দেশত্যাগে বাধ্য করলেন। হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, “যে ব্যক্তি আমার কোন প্রিয়পাত্রের সাথে শত্রম্নতা করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।” এক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটল। উক্ত ঘটনার এক মাসের কম সময়ের মধ্যেই খলিফার পক্ষ থেকে খালিদকে গর্ভনরের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং তাকে একটি গাধার পিঠে আরোহণ করিয়ে শহর থেকে বের করে দেয়া হয়।
Permission is taken from Source http://prothom-aloblog.com/users/base/lovelu1977/