মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আশরাফুল মাখলুকাত মানব জাতিকে পৃথিবীতে প্রেরণ করে কতিপয় মহৎ গুণে গুণাম্বিত করেছেন। এ মহৎ গুণাবলীর মাধ্যমেই মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। এমনই একটি গুণ হল অপরের প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিও বটে। এছাড়া আল্লাহপাকের ৯৯টি গুণবাচক নামের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হল ‘আর রাহমান’ বা পরম দয়ালু। তিনি তাঁর দয়ার মহাসমুদ্র থেকে একবিন্দু দয়া তাঁর প্রিয় বান্দাদের দান করেছেন। এজন্যই অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শন মানব জাতির বিশেষ করে মুমিনদের একটি অপরিহার্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা•) বলেন, ‘রাসূলকে (সা•) বলতে শুনেছি- আল্লাহতায়ালা দয়াকে একশ’ ভাগে ভাগ করেছেন। তার মধ্যে ৯৯ ভাগই নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন এবং পৃথিবীতে বাকি একভাগ মাত্র অবতীর্ণ করেছেন- যা দিয়ে গোটা সৃষ্টিকুল একে অপরের প্রতি দয়াপরবশ হয়, এমনকি ঘোটকী তার পায়ের ক্ষুর এ আশংকায় উঠিয়ে নেয় যে, পাছে যেন তার শাবক ব্যথা না পায়।’ (বুখারি) আর তাই তো দেখা যায়, মুমিনদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জালিম, নির্দয়, বেরহম, পাষাণ ও হৃদয়হীন না হওয়া; বরং সমগ্র মানবতার জন্য স্নেহশীল, করুণাপ্রবণ, সহানুভূতিশীল এবং পরস্পরের দুঃখে-সুখে পাশে দাঁড়ানো। ব্যক্তিগতভাবে একজন মুমিন আল্লাহর করুণার মূর্ত প্রতীক এবং দলগতভাবেও মুমিনের দল আল্লাহর এমন এক নবীর প্রতিনিধি যার প্রশংসায় বলা হয়েছে- বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ও করুণা হিসেবেই আপনাকে পাঠিয়েছি। (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭)।
বিশ্বজগতের রহমত মহানবী মুহাম্মদ (সা•) নিজের উম্মতের মধ্যে এই রহম ও করুণাবৃত্তিটির মতো উন্নত নৈতিক বৃত্তিটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রসারিত ও বিকশিত করতে চেয়েছেন, এমনকি সফলও হয়েছেন। তাঁর সময়ে তাঁর যোগ্য অনুসারীরা তাঁর প্রতিটি প্রদক্ষেপ, প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার কারণেই তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সীসাঢালা প্রাচীরের মতো মজবুত ছিল।
রাসূল (সা•) সবসময়ই সাবধান করে দিতেন এই বলে যে, তোমরা অপরের দেখাদেখি কোন কাজ কর না এবং একথাও বল না যে, অন্যরা অনুগ্রহ করলে আমরাও অনুগ্রহ করব এবং অন্যরা জুলুম করলে আমরাও জুলুম করব; বরং তোমরা এ বিষয়ে মনকে পাকাপোক্ত করে নাও যে, অন্যরা অনুগ্রহ না করলেও তোমরা অনুগ্রহ করবে এবং অন্যরা জুলুম করলেও তোমরা জুলুম করবে না (বরং অনুগ্রহ করবে)। (তিরমিযি)।
তিনি আরও বলেন, যে মানুষের প্রতি রহম করে আল্লাহ তার প্রতি রহম করেন। ‘পৃথিবীবাসীর প্রতি রহম কর তাহলে আকাশবাসী তোমার প্রতি রহম করবেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিযি) হাদিস থেকে অনুমেয়, আল্লাহর দয়া পেতে হলে তাঁর সৃষ্টিজীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে হবে।
আজ জাতি হিসেবে আমরা চরম দুঃসময় অতিক্রম করছি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম মানুষের বিশেষ করে নিম্ন আয়ের লোকদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় অনেকে অনাহারে-অর্ধাহারে, একাহারী জীবনযাপন করছে। অর্থাৎ আমাদের সমাজে যারা দিনমজুর, শ্রমিক ও ভূমিহীন কৃষক তারা আজ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকে আত্মসম্মানবোধের কারণে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকার কথা কারও কাছে মুখ খুলে বলতে পারছে না। এ অবস্থায় সমাজে বিত্তবান লোকদের ঈমানী দায়িত্ব হল তার
প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। রাসূল (সা•) বলেছেন, যে ব্যক্তি তৃপ্তি সহকারে পেট পুরে ভক্ষণ করে আর তারই পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে, সে ঈমানদার নয়। (বায়হাকি) তিনি আরও বলেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে সাহায্য করা থেকেও বিরত থাকবে না। যে ব্যক্তি নিজের ভাইয়ের কোন প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। (বুখারি ও মুসলিম)।’ এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ মানুষের জন্যই। আল্লাহকে খুশি করার জন্যই মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হতে হবে। আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। কেননা নবীজী বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি রহম করে না, আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না। (বুখারি ও মুসলিম)।
অতএব একজন মুসলমান হিসেবে তো বটেই, একজন মানুষ হিসেবেও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব অপরের প্রতি দয়াপরবশ হওয়া, নিজের মনের পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন করা। দু’দিনের এ দুনিয়ায় আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের মন-মানসিকতা তৈরি করা এবং মানুষকে ভালোবাসতে শেখা। তাহলেই ইহজাগতিক ও পারজাগতিক অনাবিল সুখ-শান্তি অর্জন করা সম্ভব?
Permission is taken from Source http://prothom-aloblog.com/users/base/lovelu1977/